চোরাবালি by (পিনুরাম) পর্ব পাঁচ। রাগ অনুরাগ (#10-#35)


ঝন্টুর ফোন রাখতেই গর্জে ওঠে অভি,  “এই শালাকে কেটে ফেলে দেবো।”
দিয়া ওর হাত দুটো ধরে মিনতি করে, “প্লিজ বুবু, এমন কিছু কর না।”
অভি ভুরু কুঁচকে বলে, “দেখো দিয়া, তোমার ওপরে কোন আঘাত আমি সহ্য করব না, সে আঘাত যে কেউ করুক। তোমাকে টাকা দিয়েছে বলে তোমাকে কিনে নিয়েছে নাকি? ওই শালার গলার ওপর পাড়া দিয়ে ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দেবো।” দিয়া ভীষণ ভাবেই ভয় পেয়ে যায়। অভি বলে, “তুমি এখুনি লেখাকে ফোন করে সব জানিয়ে দাও।”
দিয়া চাপা আর্তনাদ করে ওঠে, “নাহহহহ”
অভি জিজ্ঞেস করে, “কেন না? লেখার জানা উচিত ওর বরের আসল চরিত্র। ... দেখো দিয়া...”
দিয়া মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, “লেখা খুব ভেঙ্গে পড়বে গো।”
অভি দিয়ার হাত ধর বলে, “লেখার জন্য বড্ড চিন্তা হচ্ছে আর ঝন্টু তোমাকে এইসব ইশারা করল তার বেলায় কিছু নয়?”
দিয়া মাথা নিচু করে নরম সুরে বলে, “না মানে...”

অভি চোখ বুজে বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকে। কান গরম, কানের মধ্যে থেকে মনে হয় যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। লেখার সাথে বৌদি হিসাবে হাসি ঠাট্টা যে করে না সেটা নয়, ওর হাসি ঠাট্টা, ইয়ার্কি মশকরা সব কিছুই সবার সামনে, একটা মিষ্টতার ছোঁয়া ভালোলাগার ছোঁয়া যেখানে কোন কুটিলতা থাকে না, কাম ঘন্ধ থাকে না। বসিরহাটের সেই রাতের ঘটনা অকস্মাৎ ঘটে গিয়েছিল, সেই রাতের নিষিদ্ধ চুম্বনে কোন কুটিলতা ছিল না, কোন দুরভিসন্ধি ছল চাতুরি ছিল না, দুই জনের ভেতরেই নিষিদ্ধ অভিলাশের ছোঁয়া ছিল। কিন্তু দিয়ার সাথে ঝন্টু যেভাবে কথাবার্তা বলল তাতে ভীষণ ভাবেই এক দুরভিসন্ধির ছোঁয়া, এক ভীষণ কুটিল ছলের ধোঁয়া, ঝন্টুর কণ্ঠে টাকার পরিবর্তে নারী মাংসের ক্ষুধা, ভীষণ ভাবেই অভিকে আহত করে।

অভি ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “না মানে কি, না মানে? সেই ছোটবেলা থেকে ঝন্টুকে আমি চিনি। বিয়ের আগে যা করেছে সেটা আলাদা ব্যাপার। কলেজের দিনে অনেক প্রক্সি দিয়েছি...”
দিয়া ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে, “মানে ?”
অভি চোয়াল চেপে বলে, “কলেজ থেকেই ওর অনেক বান্ধবী ছিল। মামার কাপড়ের দোকান, সেখান থেকে টাকা মেরে অনেক ফুর্তি করেছে সেই সময়ে। কিন্তু আমার গায়ে আগুন লাগলে আমি চুপ থাকবো না, সে যেই হোক না কেন।”
দিয়া ওর হাত দুটো ধরে বলে, “একটু শান্ত হও...”
অভি চোয়াল চেপে বলে, “কিসের শান্ত?”
দিয়া ওর কাঁধে মাথা রেখে নরম সুরে বলে, “জানো কত কিছু ভেবে এসেছিলাম... তুমি না এইসব জিজ্ঞেস করে মুড খারাপ করে দিলে...”
অভি দিয়ার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা, আমি মুড খারাপ করেছি? তুমি এই নিয়ে গুমড়ে থাকতে সেটা ভালো লাগতো কি?”
অভির ভালোবাসা দেখে দিয়ার চোখ জোড়া ছলাত ছলাত করে আসে, “তুমি...”
অভি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলে, “আমি আছি, আমি ঝন্টুকে দেখে নেব আর বাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।”

অভিকে মাথা নিচু করে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখে দিয়ার ভীষণ ভয় হয়। ঠিক এটাই ভয় পাচ্ছিল, মনে প্রানে কাউকে নিজের এই সমস্যার মধ্যে জড়াতে চায়নি, আর তাই এখন পর্যন্ত লেখাকেও এই কথা জানায়নি দিয়া। আগে দিয়ার সাথে ঝন্টু বেশ হাসি ঠাট্টা করত, ইয়ার্কির ছলে অনেকবার অনেক কিছুই বলেছে। তবে সম্প্রতি অভির দিদির বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকে ঝন্টুর কথাবার্তার ধরন বেশ পালটে যায়। যেন সব সময়ে একটু ভিন্ন ইশারা, চোখের মধ্যে একটা খিদে। এই ধরনের চাহনি, এই ধরনের হাতছানি ওকে প্রায় প্রত্যেকদিন সইতে হয়। এসবের থেকে নিজেকে নিপুণ ভাবে বাঁচাতে জানে দিয়া, অনেক বিয়ে বাড়িতে যেতে হয়, অনেকের সাথে মিশতে হয়। কিন্তু এইভাবে এই হাতছানি ওর সাধের বান্ধবী লেখার স্বামীর কাছ থেকে আসবে সেটা একটু ভাবিয়ে তোলে দিয়াকে। বিয়ের কটা দিন নিজেকে ঝন্টুর হাত থেকে নিপুণ ভাবেই বাঁচিয়ে গেছে, কিন্তু ফোনে যেভাবে গতকাল কথা গুলো বলল তাতে ভীষণ আহত হয়েছে, নিজেকে নিজের কাছে ভীষণ ভাবেই ছোট মনে হয়েছে, মনে হয়েছে যেন টাকার বিনিময়ে ঝন্টু ওকে কিনে নিতে চাইছে।
অভির হাত ধরে দিয়া মনতি করে বলে, “প্লিজ মাথা গরম কর না। আমি তোমার সঙ্গে আছি বা আমাদের এই ব্যাপারে ওরা কিন্তু কেউই জানে না।”
অভি খানিকক্ষণ দিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে বলে, “আচ্ছা বেশ, আমি এই নিয়ে ঝন্টুর সাথে কিছু কথা বলব না। তবে এখন একটা ফোন করব ওকে।”
দিয়া ভয়ে কুঁকড়ে যায়, “কি বলবে?”
অভি ওকে অভয় দিয়ে বলে, “চিন্তা নেই, এমন কিছু বলব না যাতে আমাদের ব্যাপারে ওরা কিছু জানতে পারে। তবে ফোনটা করতে দাও...” বলে এক বাঁকা হাসি দেয় দিয়ার দিকে দেখে।

অভি নিজের ফোন থেকে ঝন্টুকে ফোন করে, “কি রে বাল কেমন আছিস? দিদিভাইয়ের বিয়ের পরে একবার ও ফোন করলি না যে?”
ঝন্টু হেসে ফেলে, “আর বলসি না, বহুত ব্যাস্ত। সামনে পঁচিশে ডিসেম্বর আর ফারস্ট জানুয়ারি। দোকান সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি রে।”
দিয়ার দিকে তাকিয়ে ঝন্টুকে হেসে উত্তর দেয়, “আচ্ছা আমার জানেমন কেমন আছে? অনেকদিন দেখা হয়নি? একদিন বাড়িতে আয়।”
ঝন্টু হেসে ফেলে, “হ্যাঁ ভালো আছে। আর তোর খবর বল?”
অভি, “আমার আর খবর কি, একা একা বসে নাড়াচ্ছি এই আর কি।” দিয়ার দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে কপট সুর এনে বলে, “আরে ওই দময়ন্তীর কি খবর রে?”
দিয়া ভুরু কুঁচকে অভির দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকায়। অভি ইশারায় চুপ থাকতে বলে।
ঝন্টু হেসে ফেলে, “আরে কোন খবর নেই রে মালটার।”
মাল কথা শুনে দিয়ার ইশারা করে জানায় ঝন্টুর গাল ফাটিয়ে দেবে। অভি ওকে শান্ত করে ঝন্টুকে জিজ্ঞেস করে, “ওহ, আমি ভাবলাম একটু যদি...”
ঝন্টু হেসে ফেলে, “তুই বাল একা একা নাড়া, ও মেয়ে তোর টাইপের নয়।”
দিয়ার দিকে চোখ টিপে তাকিয়ে অভি হেসে ফেলে, “আমার টাইপের নয় মানে?”
ঝন্টু গলা নামিয়ে বলে, “মানে খুব চঞ্চল, খুব দুরন্ত টাইপের বুঝতে পারছিস তো কি বলছি।”
অভি দিয়ার দিকে চোখ টিপে হেসে ঝন্টুকে উত্তর দেয়, “হুম, ঠিক বলেছিস। লেখা একদম আমার টাইপের, শান্ত মিষ্টি... শালা আমার আগেই তুই উড়িয়ে নিলি।”
লেখার সম্বন্ধে “শান্ত আর মিষ্টি” উপমা শুনতেই দিয়া অভির বাজুতে একটা জোরে চিমটি কেটে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা বাবা, আমি মিষ্টি নই তাহলে? অভি, প্রেমিকাকে সান্ত্বনা দিয়ে ইশারায় জানায়, যে তুমি আমার মুয়াআহহহহহহ...
ঝন্টু হেসে ফেলে, “শালা আর কাউকে পেলি না শেষ পর্যন্ত আমারটাকে নিয়ে টানাটানি।”
অভি হাসে, “কেন তোর ইন্সিকিওর ফিল হচ্ছে নাকি?”
ঝন্টু হেসে দেয়, “বাল কিসের ইন্সিকিউরিটি রে? পিসি তোর জন্য মেয়ে খুজবে তাকেই বিয়ে করিস।”
দিয়ার দিকে দেখে, অভি চোয়াল চেপে হেসে দেয়, “চ্যালেঞ্জ করছিস নাকি?”
ঝন্টু, “কিসের?”
অভি, “লেখাকে পটানোর।”
ঝন্টু হাহা করে হেসে দেয়, “আমি জানি, তোর দ্বারা হবে না।”
অভি, “কি বলিস, লেখা মেরে দিল কা টুকরা।”
হেসে দেয় ঝন্টু, “তো?”
অভি, “মনে আছে আকাশের কথা।”
ঝন্টু, “হ্যাঁ, ওই যার পা ভেঙ্গে দিয়েছিলি তো।”
অভি, “হ্যাঁ। দিদিভাইয়ের জন্য যদি কারুর পা ভাঙতে পারি তাহলে বুঝতে পারছিস লেখার জন্য কি করতে পারি।”
ঝন্টু হেসে ফেলে, “কি আর করবি তুই, রাতে বাল ছিঁড়ে আঁঠি বাঁধবি আর কি।”
অভি চোয়াল চেপে হেসে বলে, “লেখার জন্য আমি কিন্তু তোকেও কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে পারি।”
অভির কথাটা রসিকতা ভেবেই ঝন্টু হেসে বলে, “যা যা, তুই বাল ছিঁড়ে আঁঠি বাঁধ গে যা।”
অভি হেসে বলে, “বেশ তবে তাই হোক, চ্যালেঞ্জ রইল কিন্তু।”

ফোন রেখে দিল অভি। দিয়া অভির চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে যে এরপর কি করতে চলেছে। লেখার সাথে নোংরামো কিছু করলে তাহলে ঝন্টুর মধ্যে আর অভির মধ্যে তফাত কোথায়? একজন টাকার বিনিময়ে শরীর চেয়েছে, অন্যজনে চ্যালেঞ্জ হিসাবে ওর বান্ধবীকে কি বিছানায় চাইবে? না অভি এমন মানুষ নয়, যদিও মাত্র কয়েকদিনের চেনা পরিচিতি কিন্তু ছেলেটাকে দেখে এমন মনে হয়না।

অভির হাতের ওপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি লেখার সাথে কি করবে?”
দিয়ার আশংকিত চেহারা দেখে অভি হেসে ফেলে, “এই, আমি লেখার সাথে কিছুই করব না।”
দিয়া গভীর ভাবে অভির দুই চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এই চ্যালেঞ্জ ?”
অভি মুচকি হাসে, “আমি অতশত ভেবে কাজ করিনা দিয়া। আমি একটু ইম্পালসিভ বলতে পারো, মাথায় হুট করে কিছু এসে গেলে তখন কি করব সেটা জানি না। ঝন্টুর এই ধরনের কথাবার্তা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তাই লেখাকে নিয়ে এই চ্যালেঞ্জের কথা বললাম।”
দিয়া মাথা নাড়িয়ে ভাবনাগ্রস্থ হয়ে বলে, “সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু তুমি কার পা ভেঙ্গে দিয়েছ?”
অভি এবারে হেসে ফেলে, “আরে সে অনেকদিন আগের কথা। দিদিভায়ের সাথে একটা ছেলে খুব খারাপ ব্যাবহার করেছিল তাই তার পা ভেঙ্গে দিয়েছিলাম।”
দিয়া অভির কথা শুনে বেশ কিছুক্ষন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর প্রশ্ন করে, “তাহলে এত কথা যে ঝন্টুর সাথে বললে সেটা কি কারনে?”
অভি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলে, “দেখো, সে সব নিয়ে এখন ভাবিনি, পরে দেখা যাবে।” দিয়ার চোখের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখে বলে, “তবে তোমার সাথে ঝন্টু যা করেছে তার খেসারত ওকে দিতে হবে।”
(চলবে)

Post a Comment

1 Comments