অফিস থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে বসতে মনীষা চা নিয়ে ঢুকলেন।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে স্ত্রীকে এক নজর দেখে সুনীলবাবু বলল,ভাইকে দেখছিনা কোথায় পাঠালে?
–পাঠাতে যাবো কেন?ও হালিশহর গেছে।
–হঠাৎ হালিশহর?
–তুমি সম্পর্ক না রাখতে পারো নিজের বোনকে আমি অস্বীকার করব কি করে?
সুনীলবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে হাসল।সম্পর্ক হয় সমানে-সমানে।
–তুমি সরকারী কেরাণী ও ডাক্তার।
–ডাক্তার?সুনীলবাবুর ঠোট উলটে বললেন,আমার কাছে লোকটা একজন হকার।
–কাউকে সম্মান করতে না পারো অসম্মান কোরো না।পরিশ্রম করে উপার্জন করে
অসদুপায়ে উপায়ে তো করেনা।
সুনীলবাবু কাপে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেল।অসদুপায়ে মানে?
–রান্নাঘরে অনেক কাজ পড়ে আছে।বসে বসে ছাইপাশ বকার সময় নেই আমার।
–এই বুঝি তোমার সম্মান দেখানোর ছিরি?একটা কথা শুনে রাখো যা করি তোমাদের জন্য
করি–।
হঠাৎ টুকুন ঢুকে বলল,বাপি তুমি মামণিকে একদম বকবে না।
–এসো মা।তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষন?পড়াশোনা করছো না?
–মামু নেই কে পড়াবে?
মনীষা বলল,এসো আমার সঙ্গে আমি পড়াচ্ছি।
–না রান্নাঘরে আমি পড়বোনা।বাপি পড়াবে।
সুনীলবাবু মুস্কিলে পড়ে গেলেন।মনীষা বলল,বাপি খেটেখুটে এল এসো মামণি তোমার ঘরে গিয়েই আমি পড়াবো।
সুনীলবাবু মেয়েকে খুবই ভালবালেও তাকে পড়াবার কথা উঠলেই বিব্রতবোধ করে।লেখাপড়ার সঙ্গে কোন জন্মে সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে আবার নতুন করে সেই আড়ি ভাঙ্গার কথা ভাবলে গায়ে জ্বর আসে।মনীষা মেয়েকে নিয়ে চলে গেল।
সরকারী কর্মচারিদের খুশি করতে সকলেই কিছু দিতে চায়।বহুকাল ধরে চলে আসছে এই দস্তুর।সবাই জানে,লুকিয়ে চুরিয়ে তো কিছু করছি না।একে অসদুপায়ে উপার্জন করা বলে?
ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করা খুব সম্মানের কাজ।লোককে ভায়রা বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা করে।
মণীষা পড়াতে বসেছে।টুকুন জিজ্ঞেস করল,মামণি মামু কবে আসবে?
–আসবে।কতদিন পর মাসীর বাড়ি গেল।তুমি পড়ো।
ও জানে না ঋষিকে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছে।জানলে অশান্তি করবে।মনীষার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্য জানতে চায় ঋষিকে পাঠানোর উদ্দেশ্য।বিদিশার কাছে শুনেছে সুদেব কবিরাজী করে আয় খুব একটা ভাল নয়।সুদেব ছেলেটা খারাপ নয় বড্ড একরোখা।আজকালকার দিনে অত মেজাজ হলে চলে?
ঋষী পৌছে দেখল উঠোনের একপাশে দেবুদা মাছ কাটতে বসেছে।তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল,আরে ঋষিবর হঠাৎ আগমন?
–তুমি মাছ কাটছো?
–তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল?
–তা নয় ছোড়দি নেই?
–ঋষী মানে জ্ঞানী।তুমি কি মনে করো আনাজপাতি কাটা রান্নাবান্না করার জন্যই ঈশ্বর মেয়েদের সৃষ্টি করেছে?
দেবুদা তর্ক করতে ভালবাসে এজন্য অনেকে দেবুদাকে পছন্দ করেনা। দেবুদাকে ঋষির খুব ভাল লাগে।স্বচ্ছ মনের মানুষ।
সুদেব হেসে বলল,দাড়িয়ে কেন ভিতরে যাও দিশা ঘরেই আছে।
বিদিশা হেলান দিয়ে বিছানায় বসে আছে।ঋষিকে দেখে সোজা হয়ে বসে বলল,আয়।কখন বেরিয়েছিস?
–তোকে ব্যস্ত হতে হবে না তুই বোস ছোড়দি।ঋষি পকেট থেকে টাকা বের করে এগিয়ে দিতে বিদিশা বলল,টাকা তোর কাছে রেখে দে।তুই যদি এজন্য এসে থাকিস এখুনি বিদায় হ।
ঋষি হেসে বলল,অত দূর থেকে এলাম কিছু না খেয়ে বিশ্রাম না করেই বিদায় নেবো?
–বোকার মত হাসিস নাতো।গা জ্বলে যায়।
–যে বোকা সে কিভাবে চালাকের মত হাসবে তুই বল?ছোড়দি টাকাটা না নিলে বড়দি খুব কষ্ট পাবে।
–আমি জানি কষ্ট পাবে।মনীদি যদি টাকাটা লুকিয়ে না দিত তাহলে কিছু বলতাম না।
–তুই কি করে বুঝলি লুকিয়ে দিয়েছে?
–তুই সত্যিই বোকারে ঋষি।ঠিক আছে টাকাটা ওই তাকের উপর রাখ।ডাক্তার কি করছে?তোর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
–উঠোনে বসে মাছ কাটছে।
বিরক্ত হয়ে বিদিশা বলল,এবার বুঝতে পারলি কত শান্তিতে আছি।ঘরের মধ্যে রোগী করে বসিয়ে রেখেছে বলতো কার ভাল লাগে?
–এখন তোর সাবধানে থাকতে হবে–।
–তুই থামতো।ওকালতি করতে এসেছে।
বিদিশা খাট থেকে নেমে বাইরে দরজার কাছে দাড়াতে দেখল,সুবি এসে বলছে বাবা পেশেণ্ট এসেছে।
সুদেব বলল,বলো বাবা কলে গেছে।
সুবি চলে যেতে পা বাড়িয়েছে বিদিশা ডাকল,এই সুবি দাড়া।
সুবি মাকে দেখে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।গভীর মনোযোগ দিয়ে মাছ কাটছে সুদেব।
–বাঃ বাপ হয়ে ছেলেকে ভালই শিক্ষা দিচ্ছো?তুমি ওঠো হাত ধুয়ে এখনি যাও।রোগী বসে আছে উনি লুকোচুরি খেলা শুরু করেছেন।এই সুবি ভিতরে আয় মামা এসেছে।
সুবি ভিতরে ঢুকে ঋষিকে দেখে থমকে দাড়ালো।খুব একটা দেখা হয়না চিনতে পারেনি।
দিদিশা বসতেই সুবি মায়ের কোল ঘেষে বসল।আড়চোখে ঋষিকে দেখে।ঋষির খারাপ লাগে আসার পথে ওর জন্য কিছু আনা উচিত ছিল।
–আচ্ছা ছোড়দি দেবুদা এখন ট্রেনে হকারি করেনা?
–আমি মানা করে দিয়েছি।কিছুক্ষন ভেবে বলল,ভাল একটা দাতের মাজন বের করেছিল।
আমিও ব্যবহার করি সত্যিই খুব ভাল।পাইওরিয়ায় খুব উপকারি।ট্রেনে ভালই বিক্রি হত।
দেখলাম পাচজনে পাচকথা বলছে দরকার নেই টাকার।কয়েকটা হকার মাল নিয়ে যায় কিন্তু বুঝিয়ে বলতে হবে তো?চলছে একরকম।
ঋষি বালিশের পাশ থেকে একটা খাতা বের করে দেখল পাতায় পাতায় কবিতা।জিজ্ঞেস করল,দেবুদা লিখেছে?
বিদিশা হাসল,ঐ ওর পাগলামী।তারপর বলল, লোকটার অনেক গুণ ছিল একটু যদি সাপোর্ট পেত তাহলে–।
ঘরের মধ্যে পরিবেশ গুমোট মনে হয়।ঋষি বলল,চলো মামু একটু ঘুরে আসি।
সুবি মাকে আকড়ে ধরে বিদিশা বলল,যাও মামা ডাকছে।
সুবিকে নিয়ে ঋষি বেরিয়ে গেল।হালি শহর আর আগের মত নেই অনেক বদলে গেছে।
কিছুটা যেতে সুবি বলল,মামু ঐ দেখো বাবা বসে আছে।
ঋষি দেখল দেবুদা সামনে কয়েকজনকে নিয়ে বসে আছে।ঋষি জিজ্ঞেস করল,এখানে বিস্কুট লজেন্সের দোকান নেই?
সুবি হাত তুলে দেখালো ওদিকে আছে।খানিক এগিয়ে দেখল বেশ বড় স্টেশনারী দোকান।
–একটা বড় ক্যাডবেরি দেবেন?ঋষি জিজ্ঞেস করল।
ক্যাডবেরি নিয়ে দাম মিটীয়ে দিল।সুবির হাতে দিয়ে ফেরার পথে নজরে পড়ল,নিরাময়।নীচে লেখা কবিরাজ সুদেব সেন।চেম্বারে একজন মহিলা।ঋষি ঢুকতে যাবে মহিলা উঠে দাড়াল।সুদেব বলল,কি করছেন ফিজ না দিলেন ওষুধের দামটা অন্তত দিন।মহিলা আচল থেকে আরও পাচটাকা দিয়ে বেরিয়ে গেল।ঋষিকে দেখে বলল,এসো ভাই।ধুস এভাবে চলে?
–কি হল?ঋষি জিজ্ঞেস করল।
–আর বোলো না।একশো টাকার জায়গায় ষাট টাকা দিয়ে গেল।
–তুমি কিছু বললে না?
–কি বলব গরীব মানুষ।তোমরা বোসো ওদিকে মাছ রেখে এসেছি আমার কি শান্তিতে চিকিৎসা করার যো আছে?
সুদেব চলে যেতে মামা ভাগ্নে চেম্বারে বসল।ঋষি জিজ্ঞেস করল,বাবা ভাল না মা ভাল?
–বাবা খুব রাগী।
–মাকে বকে?
সুবি খিল খিল করে হাসতে থাকে।ঋষি বলল,হাসছো কেন?
হাসি থামিয়ে সুবি বলল,বাবা খুব ভয় পায় মাকে।
ঋষির খুব মজা লাগে।দুজন লোক এসে বসতে সুবি ছুটে বাড়ী গেল বাবাকে ডাকতে।
বাসায় ফিরে সুদেব দেখল মাছ কাটা সারা।দিশা রান্না করতে বসেছে।সুদেব অসহায় ভাবে বলল,আমাকে একটু শান্তি দেবে না?
–এই রাতে তোমাকে মাছ আনতে কে বলল?
–বাঃ ঋষি এল তাহলে কি ডাল্ভাত খাবে?
–একদম বাজেকথা বলবে না।ঋষি এল তো সন্ধ্যে বেলা।
সুদেব ঘর থেকে একটা মোড়া এনে বলল,ঠিক আছে।এভাবে মাটিতে বোসো না এর উপর বসে রান্না করো।
–বাবা পেশেণ্ট এসেছে।সুবি এসে খবর দিল।
–তুমি মার কাছে থাকো।সুদেব আবার চেম্বারে চলে গেল।
ছোড়দির সংসার দেখে খুব ভাল লাগে ঋষির।ছোড়দির গিন্নী-গিন্নীভাব দেখে মজা লাগে।ছোটো বেলার ছোড়দির সঙ্গে মেলাতে পারে না।বিদিশা ছিল ডানপিটে এলোমেলো স্বভাব।
এখানকার জিনিস ওখানে ফেলে রাখত।বড়দি বকাবকি করত কিন্তু ছোড়দি যে-কে সেই।
এখন ছোড়দি সংসারের কর্তৃ।দেবুদা একটু খেয়ালি অলস প্রকৃতি ছোড়দি মেজাজ শান্ত রেখে সবদিক সামলে চলেছে।
খেতে বসে বিদিশা জিজ্ঞেস করল,তোর রেজাল্ট কবে বেরোবে?
–সময় হয়ে এলো।
–কি করবি পাস করে?
ঋষি বলল,কিছু ঠিক করিনি।
–তুই বদলালি না সেই আগের মতই আছিস।মনিদি কি বলছে?
–বড়দির এককথা নিজের পায়ে দাড়া।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বিদিশা মুখ দিয়ে শুধু বলল,হুউউম।
শুতে যাবার আগে ঋষী বলল,ছোড়দি আমাকে কাল যেতে হবে?
–কালই?বিদিশা জিজ্ঞেস করল।
–হ্যারে টিউশনি আছে।
–তোকে একটা কথা বলি।একটা কিছু স্থির করে নে কি করবি?তোর দেবুদাকে দেখছিস না?
কবিতা লিখবে না কবিরাজী করবে ঠিক করে উঠতে উঠতে বেলা বয়ে গেল।
–দেবুদা তোকে খুব ভালবাসে।
–সেকথা তোকে বলতে হবে? অমুক গরীব অমুকের কষ্ট ভেবে তুমি কি করবে?তাদের জন্য কিছু করার মত মুরোদ না থাকে। আচ্ছা শুয়ে পড়।বিদিশা চলে যেতে গিয়ে ফিরে এসে বলল, আর শোন মনিদিকে বলবি আমি ভাল আছি যেন বেশি চিন্তা না করে।
কঙ্কার মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল।তার উপর বন্দনাদি দেখা হতে জিজ্ঞেস করল,তুই কখনো খেয়েছিস?যাওয়ার সময় পই পই করে বলেছিল পৌছে খবর দিবি।ঋষিটার সময় হলনা।বন্দনাদি জিজ্ঞেস করল,রাগ করলি?
কঙ্কা হেসে বলল,রাগ করব কেন?
–আগে কখনো খাইনি কালকেই খেলাম।
–খুব মিষ্টি?কঙ্কা মজা করে বলল।
–ধ্যৎ আমি তাই বলেছি?টক-মিষ্টি না অন্য রকম তোকে বলে বোঝাতে পারব না।
–তাহলে বলছো কেন?
–বুঝেছি তুই রাগ করেছিস।বন্দনাদি মনক্ষুন্ন হল।
কালকের ব্যাপার মিটে গেছে কাল।তাই নিয়ে কচলাকচলি ভাল লাগে না।এত বয়স হল তবু হাঘরেপনা গেলনা।ঋষি দুষ্টুমি করে দেখাচ্ছিল বন্দনাদির ছোটো পাপড়ি বেরিয়ে এসেছে।কঙ্কা ক্লাসে ঢুকে গেল।কি আক্কেল ছেলেটার একটা ফোন করার সময় হল না?
কঙ্কা থার্ড পিরিয়ডে ইলেভেনে ক্লাস নিচ্ছে,ফোন বেজে উঠল।কঙ্কা ক্লাস থেকে বেরিয়ে ফোন ধরে বলল,এখন পৌছালি?
–এইমাত্র ট্রেন থেকে নামলাম।
–মানে?
–এবার বাড়ীর দিকে যাবো।
–তোকে ধরে পেটাতে হয়।বাদর ছেলে কোথাকার?
–এখন সম্ভব নয়।যখন যাবো তখন পিটিও যা খুশি কোরো।
–সারারাত চিন্তায় চিন্তায় আমি ঘুমোতে পারিনি তুই জানিস?
–এখন রাখছি?
ঋষি বাড়ির দিকে হাটতে থাকে।মনে মনে ভাবে আমার মত বাউন্ডূলে ছেলের জন্য কেন তোমরা এত চিন্তা করো?ছোড়দি ঠিকই বলেছে কারো জন্য কিছু করার মত কি যোগ্যতা আছে আমার?রুমাল বের করে চোখ মুছল।
(চলবে)
0 Comments