ভোরবেলা ঘুম হতে উঠে ড.এমা দেখল সোফায় কুকড়ে শুয়ে আছে ঋষি।হাতের পেশী ফুলে উঠেছে।মুখখানা নিষ্পাপ নিরীহ। দোতলায় দুটো গেস্ট রুম আছে।ঋষিকে তার একটায় ব্যবস্থার কথা চিন্তা করল।কাল রাতে অনেক কথা জানা গেল।
কোহিনূর পতিতা জীবন থেকে গৃহস্থ জীবনে ফিরে এসেছে।বাবুয়া তার সন্তানের পিতা।বাবুয়াকে চেনে এমা, হাসপাতাল তৈরী হবার সময় মাইতিবাবু নিয়ে এসেছিল।দাড়িয়ে থেকে বিল্ডিং তুলতে সাহায্য করেছিল।মাথার কাছে বসে চুলে হাত বোলায়।
মাইতিবাবু বলছিল একে সবাই বস বলে।ঋষি চোখ মেলে এমাকে দেখে হাসল।
ত্রিদিবেশ মাইতি সব লক্ষ্য রাখছেন।প্রতিটি খবর তিনি নিয়মিত যথাস্থানে পৌছে দিচ্ছেন।
ম্যাডাম শিঘ্রী কলকাতায় আসবেন নিজে দেখে যান মেয়ের কীর্তিকলাপ।ম্যাডাম বেশি পাত্তা দেয়না স্বামীকে কিন্তু মেয়ে অন্তপ্রাণ।ম্যাডামের নির্দেশ ত্রিদিবেশ মাইতিকে এসব খবর রাখতে হয়।
ড.এমা বলল,তুমি রেডি হয়ে নেও।আজ থেকে এখানে খাবে ক্যাণ্টিনে খেতে হবেনা।
ঋষি বুঝতে পারছে এমার আচরনে সে অন্যান্যদের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।সবাই আগের মত সহজভাবে তার সঙ্গে কথা বলে না।আবার এমার মুখের উপর কিছু বলতেও পারেনা।স্নান করে দুজনে খেতে বসল।খুব হালকাভাবে এমা জিজ্ঞেস
করল,ঋষি তুমি কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো?
ঋষি মুখে গ্রাস তুলতে গিয়ে থেমে যায়।এমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল হাসি হাসি মুখ নিয়ে ঋষি কি বলে শোনার প্রতীক্ষায়।ঋষি বলল,জীবনেও তোমাকে ছেড়ে যাবো না।তোমার মন রাখতে আমি একথা বলতে পারি।
এমার হাসি মিলিয়ে গেল বলল,মন রাখতে হবে না।
–এই মুহূর্তের আমির পক্ষে কোনোদিনের আমি সম্পর্কে বলা কি সম্ভব?
এমা মাথা নীচু করে খেতে থাকে।ঋষি বলল,তুমি রাগ করলে?
এমা হাসল বলল,তুমি যা বললে শুনতে ভাল না লাগলেও তোমাকে আমার আরও ভাল লাগছে।ঠিকই ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে।তুমি সাধুর মোড়ে যাবে?চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে মিশনে চলে যাবো।
সবাই এক গাড়ীতে যেতে দেখবে মনটা খুত খুত করে।অনিচ্ছা সত্বেও ঋষি গাড়ীতে রোহনের পাশে বসল।ব্যাপারটা এমার নজরে পড়ে মুচকি হাসল।সাধুর মোড়ে সবাই ঋষির জন্য অপেক্ষা করছিল।গাড়ী থেকে নামতে দেখে ওরা পরস্পর মুখ চাওয়া
চাওয়ি করল।
ঋষির কিহল কে জানে জানলা দিয়ে মুখ ঢূকিয়ে বলল,এসেছো যখন একবার কোহিনূরকে দেখে যাও।
এমা হেসে বলল,তুমি বললে অবশ্যই দেখতে হবে আমাকে।এমা গাড়ি হতে নেমে ঋষির সঙ্গে গলি দিয়ে কোহিনূরের ঘরে ঢূকল।কোহিনূর শুয়ে ছিল ডাক্তার ম্যাডামকে দেখে উঠে বসতে গেল।এমা হাত তুলে উঠতে নিষেধ করে ঋষিকে বাইরে যেতে বলল।
ঋষি বাইরে আসতে ভজা জিজ্ঞেস করে,বস ভাবীর কিছু হয়েছে?
–এরকম সময় মাঝে মাঝে চেক আপ করা দরকার।
–ভাবী বলছিল আজ কোর্টে যাবে না।
এমা বেরিয়ে এসে দোকানটা ভাল করে দেখল।বিশুবাবু চিনিতে পেরেছে ড.এমাকে।বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।এমা দোকান দেখে বলল,এবার আসি?
ঋষি দরজা খুলে দিল গাড়ী চলে গেল।তিনটে বাইকে পাচজনে রওনা হল।
ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে এল।কদিন পর বিএ বিএসসির রেজাল্ট বের হবে,নতুন করে ভর্তি শুরু হবে।তার উপর শনিবার।একটা ঢিলেঢালা ভাব।কল্পনা ব্রততীকে নিয়ে সিড়িতে বসে আছে। ব্রততী তার সহপাঠী।সন্দীপকে ফোন করেছিল সুইচ অফ।বাড়ি চলে যাবে কিনা ভাবছে। ব্রততী বলল,তুই দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছিস।কল্পনা হাসল।
পর্ণাকে ক্যাণ্টিন হতে বেরোতে দেখে ব্রততী বলল,ঐ মেয়েটাকে চিনিস?
–হ্যা ইংলিশ নিয়ে পড়ছে।কেন?
–ভীষণ ফাটুশ।ইংলিশে এম এ পড়ছে ভাবে কিইনা কি?
–কেন তোর সঙ্গে কিছু হয়েছে?
–আমার সঙ্গে কি হবে?সেদিন ক্যাণ্টিনে দেবাশিসের সঙ্গে গল্প করছি এমন সময় রজত ঢুকলো।সঙ্গে ঐ মেয়েটাও ছিল।দেবাশিসের পাড়ার ছেলে রজত।পর্ণাকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিল,আমার বন্ধু দেবাশিস।দেবাশিস কবি,অনেক প্ত্রিকায় ওর কবিতা
ছাপা হয়েছে।ফাটুশটা কি বলল জানিস?বাংলা কবিতা পড়ার সুযোগ হয়না।
কল্পনা উঠে পড়ল বলল,আসিরে?
বিয়ের পর থেকে সন্দীপ সেই আগের মত নেই।কল্পনা অনুভব করতে পারে শরীরে আরেকজনের উপস্থিতি।সন্দীপকে যখন বলে পেটে হাত বোলায় আর হাসে।ব্রততী বলছিল সে নাকি মুটিয়ে যাচ্ছে।সন্দীপকে বলতে হবে তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে।তার নিজেরও দোষ আছে তখন অতটা গুরুত্ব দেয়নি।তখন একটা ওষুধ খেয়ে নিলে আজ এমন হত না।
একেবারে শেষে বাবুলালের কেস উঠল।কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বাবুলালের চোখ মনে হয় কোহিনূরকে খুজছে।জজ সাহেব সিআইডি রিপোর্ট দেখে ভ্রূ কুচকে যায়।সরকারি উকিলের দিকে তাকাতে উনি মাথা নীচু করেন।জজ সাহেব বললেন,উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে।মুন্না সাউ পরপর দুটো অপরাধ করে পাড়াতেই ছিল অথচ পুলিশ রিপোর্টে তার নামই ছিলনা।
একটা মামলায় দেখানো হচ্ছে ফেরার?
হরিমাধবাবু বললেন,স্যার আমি এই মামলা খারিজ করার আবেদন করছি।
সরকারী উকিলের দিকে তাকিয়ে জজসাহেব বললেন,সিআইডি রিপোর্টে বসের কোনো অস্তিত্বই নেই।পুরানো মামলা খারিজ করে নতুন মামলা শুরুতে আপত্তি আছে?
–না স্যার।সরকারি উকিল বলল।
জজ সাহেব বাবুলালের দিকে একবার দেখে বললেন,আসামী বাবুলাল এবং বসের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস কোরে দেওয়া হল।সিআইডি কর্ত্তক অভিযোগের ভিত্তিতে শান্তি ভট্টাচার্যের খুনের অন্য মামলা শুরু হওয়ায় এই মামলা চালানো অর্থহীন।অতএব খারিজ করে দেওয়া হল।
কাগজ পত্র সই সাবুদ করতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল বাবুয়ার খালাস হতে।ঋষী সবাইকে চুপি চুপি বলল,এখন যেন কেউ তাকে বস না বলে।
বাইরে বেরিয়ে বাবুয়া বলল,বস তুমি আমার পিছনে ওঠো।
ভজা বলল,গুরু আজ তোমার চালাবার দরকার নেই।তুমি কেতোর বাইকের পিছনে বোস।
বাইক ছুটে চলল।কিছুটা যাবার পর বাবুয়া বলল,কোথায় যাচ্ছিস বলতো?
ভজা হেসে বলল,গুরু বসের অর্ডার।
বাবুয়া কিছু বুঝতে পারেনা।তাকে কি লেবু বাগানে নিয়ে যাচ্ছে?বেগম আজ আসেনি কিছু হল নাকি?সাধুর মোড়ে বাইক থামতে ঋষি এগিয়ে এসে বলল,বাবুয়া খুব খারাপ লাগছে মিথ্যে তোমাকে এতদিন জেলে থাকতে হল।
বাবুয়া হাসল বলল,বস তুমি জানো শান্তিদাকে খুন আমি করিনি।তবু আমার মনে কোনো আফশোস নেই।অপরাধ তো কম করিনি তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেল।এখানে থামলে কেন?
ভজা দোকানের সাইন বোর্ড দেখালো।
বাবুয়া সাইনবোর্ড দেখে সবার দিকে তাকায়।সবাই মিট মিট কোরে হাসছে।ঋষি বলল,চলো ভিতরে চলো।
ভিতরে ঢুকে কোহিনূরকে দেখে বাবুয়ার মুখে কথা সরে না।জিজ্ঞেস করল,তুই কবে এসেছিস? কে তোকে আনলো?
কোহিনূর কোনো কথা বলেনা।চোখ তুলে ঋষির দিকে তাকালো।
ঋষি বলল,ওখানে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিল না।
বাবুয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে এল দু-হাতে ঋষিকে জড়িয়ে ধরে বলল,বস তুমি কি?
ঋষি বলল,বাবুয়া তোমার সন্তান ওর পেটে।
তড়িদাহতের মত ঋষিকে ছেড়ে কোহিনূরের দিকে ঘুরে তাকিয়ে থাকে।কোহিনূর লজ্জায় তাকাতে পারেনা। পাশে বসে কোহিনূরকে ভাল করে দেখে বলল,তুই তো আমাকে বলিস নি বেগম?
–কাউকে বলিনি।কদিন আগে বসকে বলেছি।বস ডাক্তার দেখালো।
ভজার দিকে তাকিয়ে বাবুয়া বলল,দেখ ভজা এই আমার বস আছে।
–গুরু তূমি দেখো।বস কি করেছে আমরা জানি।ভাবীকে আজও ডাক্তার দেখিয়েছে।
বাবুয়া হাতের তালুর উল্টোদিক দিয়ে চোখ মুছল।
গঙ্গার তীরে সন্ধ্যে নেমে এল।ভাঁটির টানে বয়ে চলেছে গঙ্গা।তার তীরে দুজন বসে আছে একজন বক্তা আরেকজন মুগ্ধ শ্রোতা।স্বামী আত্মমানন্দ মহারাজ বলে চলেছেন,একটা ইটের উপর ইট রাখো দুটো ইটে সম্পর্ক স্থাপিত হল। দুটো ইটের ফাকে সিমেণ্ট বালি দিয়ে দাও সম্পর্ক আরও মজবুত হল।তাসত্বেও নোনা ধরার আশঙ্কা।সেজন্য সম্পর্ককে লালন করতে হয় যাতে আলগা নাহয়ে যায়।
সব সম্পর্ক স্বার্থের সুতোয় বাধা।স্বার্থের রকম ফের আছে।তুমি ডাক্তার তোমার ফিজ বেশি হলে যাদের টাকা আছে তোমার কাছে আসবে।আর যদি ভাল চিকিৎসক খ্যাতি অর্জন করতে পারো তাহলে যার টাকা নেই সেও ধারদেনা করে তোমার কাছে আসবে।তোমার স্বার্থ কি?তুমি অর্থ পাচ্ছো।
আরেকটা স্বার্থ আছে একজন অসুস্থ লোককে সুস্থ করে তোলার মধ্যে আছে অনাস্বাদিত তৃপ্তি।এ এক পরম পাওয়া, এই তৃপ্তি যারা পায় তাদের খ্যাতি ফুলের গন্ধের মত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
ড.এমার ফেরার সময় হল।মহারাজ অনেক বিষয়ে অনেক কথা বললেন,সব কথা এমা না বুঝলেও শুনতে ভালই লাগছিল।একটা কথা মনের কোনে উসখুস করছিল কিভাবে জিজ্ঞেস করবে ভাবতে ভাবতে বলে ফেলল, মহারাজ আমার এক বন্ধু তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিল কোনোদিন তাকে ছেড়ে যাবে কিনা–।এই অবধি বলে এমা দেখল মহারাজ মিট্মিট করে হাসছেন।মহারাজ বললেন,তোমার কথা বিশ্বাস করেছি।
এমা লজ্জিত হয়ে বলল,মহারাজ আমাকে ক্ষমা করবেন আমি সত্য বলিনি।
মহারাজ বললেন,আমি জানি।তোমার প্রশ্নের উত্তরে বন্ধু কি বলেছিল তাই বলো?
–বলেছিল এখনকার আমি ভবিষ্যতের আমি সম্পর্কে কি করে বলব?
মহারাজ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার বন্ধুকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
–কেন মহারাজ?
–দুধে কেউ এক-পোয়া কেউ দু-পোয়া জল মেশায় কিন্তু সবাই নিজের দুধকে বলে খাটি দুধ।স্পষ্ট কোরে সত্য উচ্চারণ করতে সাহসের দরকার।
–সম্পর্কের কোনো নিশ্চয়তা নেই?
–তোমাকে আগেই বলেছি সম্পর্ককে লালন করতে হয়।নারীর অনেক রূপ–পিশাচী কামিনী মায়াবিনী মোহিনী একাধারে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের রূপমূর্তী নারী।সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে মাতৃময়ী।
মায়ের বন্ধন ছিন্ন করা খুব কঠিন।
–স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মাতৃসত্তা?
–সব পুরুষ অবচেতনে নারীর মধ্যে মাতৃসত্তা অনুভব করতে চায় সে স্বামী হোক পিতা হোক বন্ধু যাই হোক।তুমি শোনোনি বাবা মেয়েকে মা বলে সম্বোধন করছে?
ড.এমার মুখে শব্দ জোগায় না।এমন কথা তার কখনো মনে হয়নি।বিশ্বাস করতে পারেনা আবার অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দেওয়ার জোর পায়না।কেমন একটা ভাব তার মনপ্রাণ আচ্ছন্ন করে থাকে। মহারাজকে প্রণাম করে উঠে বলল,আসি মহারাজ?
গাড়িতে উঠে হেলান দিয়ে বসল।দক্ষিনেশ্বর পার হতে ফোন বেজে উঠতে মুখে হাসি ফুটল।কিন্তু স্ক্রিনে ঋষি নয় ভেসে উঠল দেবেশ মাইতির নাম।কানে লাগিয়ে বলল,হ্যা বলছি।
–ম্যাডাম আগে অনেকবার ফোন করেছিলাম সুইচ অফ।
–হ্যা বলুন হয়েছে?
–হ্যা হয়ে গেছে।
–কোনো অসুবিধে হয়নিতো?
–না না রেজাল্ট ভাল অসুবিধে হয়নি।
–থ্যাঙ্ক ইউ।রাখছি?
ফোন রেখে তৃপ্তিতে ভরে গেল মন।ঋষি এখন কোথায়?নম্বর টিপল,এখনই কিছু বলার দরকার নেই।
ঋষির ফোন বাজতে দেখল জিয়া।হ্যা বল..ঠিক আছে আসছি।
ভজা বলল,বস নতুন ফোন মনে হচ্ছে?আমাকে একটা মিস কল দাও।ভজা তার নম্বর বলল।ঋষি বলল,আজ আসছি।
(চলবে)
কোহিনূর পতিতা জীবন থেকে গৃহস্থ জীবনে ফিরে এসেছে।বাবুয়া তার সন্তানের পিতা।বাবুয়াকে চেনে এমা, হাসপাতাল তৈরী হবার সময় মাইতিবাবু নিয়ে এসেছিল।দাড়িয়ে থেকে বিল্ডিং তুলতে সাহায্য করেছিল।মাথার কাছে বসে চুলে হাত বোলায়।
মাইতিবাবু বলছিল একে সবাই বস বলে।ঋষি চোখ মেলে এমাকে দেখে হাসল।
ত্রিদিবেশ মাইতি সব লক্ষ্য রাখছেন।প্রতিটি খবর তিনি নিয়মিত যথাস্থানে পৌছে দিচ্ছেন।
ম্যাডাম শিঘ্রী কলকাতায় আসবেন নিজে দেখে যান মেয়ের কীর্তিকলাপ।ম্যাডাম বেশি পাত্তা দেয়না স্বামীকে কিন্তু মেয়ে অন্তপ্রাণ।ম্যাডামের নির্দেশ ত্রিদিবেশ মাইতিকে এসব খবর রাখতে হয়।
ড.এমা বলল,তুমি রেডি হয়ে নেও।আজ থেকে এখানে খাবে ক্যাণ্টিনে খেতে হবেনা।
ঋষি বুঝতে পারছে এমার আচরনে সে অন্যান্যদের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।সবাই আগের মত সহজভাবে তার সঙ্গে কথা বলে না।আবার এমার মুখের উপর কিছু বলতেও পারেনা।স্নান করে দুজনে খেতে বসল।খুব হালকাভাবে এমা জিজ্ঞেস
করল,ঋষি তুমি কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো?
ঋষি মুখে গ্রাস তুলতে গিয়ে থেমে যায়।এমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল হাসি হাসি মুখ নিয়ে ঋষি কি বলে শোনার প্রতীক্ষায়।ঋষি বলল,জীবনেও তোমাকে ছেড়ে যাবো না।তোমার মন রাখতে আমি একথা বলতে পারি।
এমার হাসি মিলিয়ে গেল বলল,মন রাখতে হবে না।
–এই মুহূর্তের আমির পক্ষে কোনোদিনের আমি সম্পর্কে বলা কি সম্ভব?
এমা মাথা নীচু করে খেতে থাকে।ঋষি বলল,তুমি রাগ করলে?
এমা হাসল বলল,তুমি যা বললে শুনতে ভাল না লাগলেও তোমাকে আমার আরও ভাল লাগছে।ঠিকই ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে।তুমি সাধুর মোড়ে যাবে?চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে মিশনে চলে যাবো।
সবাই এক গাড়ীতে যেতে দেখবে মনটা খুত খুত করে।অনিচ্ছা সত্বেও ঋষি গাড়ীতে রোহনের পাশে বসল।ব্যাপারটা এমার নজরে পড়ে মুচকি হাসল।সাধুর মোড়ে সবাই ঋষির জন্য অপেক্ষা করছিল।গাড়ী থেকে নামতে দেখে ওরা পরস্পর মুখ চাওয়া
চাওয়ি করল।
ঋষির কিহল কে জানে জানলা দিয়ে মুখ ঢূকিয়ে বলল,এসেছো যখন একবার কোহিনূরকে দেখে যাও।
এমা হেসে বলল,তুমি বললে অবশ্যই দেখতে হবে আমাকে।এমা গাড়ি হতে নেমে ঋষির সঙ্গে গলি দিয়ে কোহিনূরের ঘরে ঢূকল।কোহিনূর শুয়ে ছিল ডাক্তার ম্যাডামকে দেখে উঠে বসতে গেল।এমা হাত তুলে উঠতে নিষেধ করে ঋষিকে বাইরে যেতে বলল।
ঋষি বাইরে আসতে ভজা জিজ্ঞেস করে,বস ভাবীর কিছু হয়েছে?
–এরকম সময় মাঝে মাঝে চেক আপ করা দরকার।
–ভাবী বলছিল আজ কোর্টে যাবে না।
এমা বেরিয়ে এসে দোকানটা ভাল করে দেখল।বিশুবাবু চিনিতে পেরেছে ড.এমাকে।বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।এমা দোকান দেখে বলল,এবার আসি?
ঋষি দরজা খুলে দিল গাড়ী চলে গেল।তিনটে বাইকে পাচজনে রওনা হল।
ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে এল।কদিন পর বিএ বিএসসির রেজাল্ট বের হবে,নতুন করে ভর্তি শুরু হবে।তার উপর শনিবার।একটা ঢিলেঢালা ভাব।কল্পনা ব্রততীকে নিয়ে সিড়িতে বসে আছে। ব্রততী তার সহপাঠী।সন্দীপকে ফোন করেছিল সুইচ অফ।বাড়ি চলে যাবে কিনা ভাবছে। ব্রততী বলল,তুই দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছিস।কল্পনা হাসল।
পর্ণাকে ক্যাণ্টিন হতে বেরোতে দেখে ব্রততী বলল,ঐ মেয়েটাকে চিনিস?
–হ্যা ইংলিশ নিয়ে পড়ছে।কেন?
–ভীষণ ফাটুশ।ইংলিশে এম এ পড়ছে ভাবে কিইনা কি?
–কেন তোর সঙ্গে কিছু হয়েছে?
–আমার সঙ্গে কি হবে?সেদিন ক্যাণ্টিনে দেবাশিসের সঙ্গে গল্প করছি এমন সময় রজত ঢুকলো।সঙ্গে ঐ মেয়েটাও ছিল।দেবাশিসের পাড়ার ছেলে রজত।পর্ণাকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিল,আমার বন্ধু দেবাশিস।দেবাশিস কবি,অনেক প্ত্রিকায় ওর কবিতা
ছাপা হয়েছে।ফাটুশটা কি বলল জানিস?বাংলা কবিতা পড়ার সুযোগ হয়না।
কল্পনা উঠে পড়ল বলল,আসিরে?
বিয়ের পর থেকে সন্দীপ সেই আগের মত নেই।কল্পনা অনুভব করতে পারে শরীরে আরেকজনের উপস্থিতি।সন্দীপকে যখন বলে পেটে হাত বোলায় আর হাসে।ব্রততী বলছিল সে নাকি মুটিয়ে যাচ্ছে।সন্দীপকে বলতে হবে তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে।তার নিজেরও দোষ আছে তখন অতটা গুরুত্ব দেয়নি।তখন একটা ওষুধ খেয়ে নিলে আজ এমন হত না।
একেবারে শেষে বাবুলালের কেস উঠল।কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বাবুলালের চোখ মনে হয় কোহিনূরকে খুজছে।জজ সাহেব সিআইডি রিপোর্ট দেখে ভ্রূ কুচকে যায়।সরকারি উকিলের দিকে তাকাতে উনি মাথা নীচু করেন।জজ সাহেব বললেন,উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে।মুন্না সাউ পরপর দুটো অপরাধ করে পাড়াতেই ছিল অথচ পুলিশ রিপোর্টে তার নামই ছিলনা।
একটা মামলায় দেখানো হচ্ছে ফেরার?
হরিমাধবাবু বললেন,স্যার আমি এই মামলা খারিজ করার আবেদন করছি।
সরকারী উকিলের দিকে তাকিয়ে জজসাহেব বললেন,সিআইডি রিপোর্টে বসের কোনো অস্তিত্বই নেই।পুরানো মামলা খারিজ করে নতুন মামলা শুরুতে আপত্তি আছে?
–না স্যার।সরকারি উকিল বলল।
জজ সাহেব বাবুলালের দিকে একবার দেখে বললেন,আসামী বাবুলাল এবং বসের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস কোরে দেওয়া হল।সিআইডি কর্ত্তক অভিযোগের ভিত্তিতে শান্তি ভট্টাচার্যের খুনের অন্য মামলা শুরু হওয়ায় এই মামলা চালানো অর্থহীন।অতএব খারিজ করে দেওয়া হল।
কাগজ পত্র সই সাবুদ করতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল বাবুয়ার খালাস হতে।ঋষী সবাইকে চুপি চুপি বলল,এখন যেন কেউ তাকে বস না বলে।
বাইরে বেরিয়ে বাবুয়া বলল,বস তুমি আমার পিছনে ওঠো।
ভজা বলল,গুরু আজ তোমার চালাবার দরকার নেই।তুমি কেতোর বাইকের পিছনে বোস।
বাইক ছুটে চলল।কিছুটা যাবার পর বাবুয়া বলল,কোথায় যাচ্ছিস বলতো?
ভজা হেসে বলল,গুরু বসের অর্ডার।
বাবুয়া কিছু বুঝতে পারেনা।তাকে কি লেবু বাগানে নিয়ে যাচ্ছে?বেগম আজ আসেনি কিছু হল নাকি?সাধুর মোড়ে বাইক থামতে ঋষি এগিয়ে এসে বলল,বাবুয়া খুব খারাপ লাগছে মিথ্যে তোমাকে এতদিন জেলে থাকতে হল।
বাবুয়া হাসল বলল,বস তুমি জানো শান্তিদাকে খুন আমি করিনি।তবু আমার মনে কোনো আফশোস নেই।অপরাধ তো কম করিনি তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেল।এখানে থামলে কেন?
ভজা দোকানের সাইন বোর্ড দেখালো।
বাবুয়া সাইনবোর্ড দেখে সবার দিকে তাকায়।সবাই মিট মিট কোরে হাসছে।ঋষি বলল,চলো ভিতরে চলো।
ভিতরে ঢুকে কোহিনূরকে দেখে বাবুয়ার মুখে কথা সরে না।জিজ্ঞেস করল,তুই কবে এসেছিস? কে তোকে আনলো?
কোহিনূর কোনো কথা বলেনা।চোখ তুলে ঋষির দিকে তাকালো।
ঋষি বলল,ওখানে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিল না।
বাবুয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে এল দু-হাতে ঋষিকে জড়িয়ে ধরে বলল,বস তুমি কি?
ঋষি বলল,বাবুয়া তোমার সন্তান ওর পেটে।
তড়িদাহতের মত ঋষিকে ছেড়ে কোহিনূরের দিকে ঘুরে তাকিয়ে থাকে।কোহিনূর লজ্জায় তাকাতে পারেনা। পাশে বসে কোহিনূরকে ভাল করে দেখে বলল,তুই তো আমাকে বলিস নি বেগম?
–কাউকে বলিনি।কদিন আগে বসকে বলেছি।বস ডাক্তার দেখালো।
ভজার দিকে তাকিয়ে বাবুয়া বলল,দেখ ভজা এই আমার বস আছে।
–গুরু তূমি দেখো।বস কি করেছে আমরা জানি।ভাবীকে আজও ডাক্তার দেখিয়েছে।
বাবুয়া হাতের তালুর উল্টোদিক দিয়ে চোখ মুছল।
গঙ্গার তীরে সন্ধ্যে নেমে এল।ভাঁটির টানে বয়ে চলেছে গঙ্গা।তার তীরে দুজন বসে আছে একজন বক্তা আরেকজন মুগ্ধ শ্রোতা।স্বামী আত্মমানন্দ মহারাজ বলে চলেছেন,একটা ইটের উপর ইট রাখো দুটো ইটে সম্পর্ক স্থাপিত হল। দুটো ইটের ফাকে সিমেণ্ট বালি দিয়ে দাও সম্পর্ক আরও মজবুত হল।তাসত্বেও নোনা ধরার আশঙ্কা।সেজন্য সম্পর্ককে লালন করতে হয় যাতে আলগা নাহয়ে যায়।
সব সম্পর্ক স্বার্থের সুতোয় বাধা।স্বার্থের রকম ফের আছে।তুমি ডাক্তার তোমার ফিজ বেশি হলে যাদের টাকা আছে তোমার কাছে আসবে।আর যদি ভাল চিকিৎসক খ্যাতি অর্জন করতে পারো তাহলে যার টাকা নেই সেও ধারদেনা করে তোমার কাছে আসবে।তোমার স্বার্থ কি?তুমি অর্থ পাচ্ছো।
আরেকটা স্বার্থ আছে একজন অসুস্থ লোককে সুস্থ করে তোলার মধ্যে আছে অনাস্বাদিত তৃপ্তি।এ এক পরম পাওয়া, এই তৃপ্তি যারা পায় তাদের খ্যাতি ফুলের গন্ধের মত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
ড.এমার ফেরার সময় হল।মহারাজ অনেক বিষয়ে অনেক কথা বললেন,সব কথা এমা না বুঝলেও শুনতে ভালই লাগছিল।একটা কথা মনের কোনে উসখুস করছিল কিভাবে জিজ্ঞেস করবে ভাবতে ভাবতে বলে ফেলল, মহারাজ আমার এক বন্ধু তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিল কোনোদিন তাকে ছেড়ে যাবে কিনা–।এই অবধি বলে এমা দেখল মহারাজ মিট্মিট করে হাসছেন।মহারাজ বললেন,তোমার কথা বিশ্বাস করেছি।
এমা লজ্জিত হয়ে বলল,মহারাজ আমাকে ক্ষমা করবেন আমি সত্য বলিনি।
মহারাজ বললেন,আমি জানি।তোমার প্রশ্নের উত্তরে বন্ধু কি বলেছিল তাই বলো?
–বলেছিল এখনকার আমি ভবিষ্যতের আমি সম্পর্কে কি করে বলব?
মহারাজ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন, তোমার বন্ধুকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
–কেন মহারাজ?
–দুধে কেউ এক-পোয়া কেউ দু-পোয়া জল মেশায় কিন্তু সবাই নিজের দুধকে বলে খাটি দুধ।স্পষ্ট কোরে সত্য উচ্চারণ করতে সাহসের দরকার।
–সম্পর্কের কোনো নিশ্চয়তা নেই?
–তোমাকে আগেই বলেছি সম্পর্ককে লালন করতে হয়।নারীর অনেক রূপ–পিশাচী কামিনী মায়াবিনী মোহিনী একাধারে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের রূপমূর্তী নারী।সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে মাতৃময়ী।
মায়ের বন্ধন ছিন্ন করা খুব কঠিন।
–স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মাতৃসত্তা?
–সব পুরুষ অবচেতনে নারীর মধ্যে মাতৃসত্তা অনুভব করতে চায় সে স্বামী হোক পিতা হোক বন্ধু যাই হোক।তুমি শোনোনি বাবা মেয়েকে মা বলে সম্বোধন করছে?
ড.এমার মুখে শব্দ জোগায় না।এমন কথা তার কখনো মনে হয়নি।বিশ্বাস করতে পারেনা আবার অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দেওয়ার জোর পায়না।কেমন একটা ভাব তার মনপ্রাণ আচ্ছন্ন করে থাকে। মহারাজকে প্রণাম করে উঠে বলল,আসি মহারাজ?
গাড়িতে উঠে হেলান দিয়ে বসল।দক্ষিনেশ্বর পার হতে ফোন বেজে উঠতে মুখে হাসি ফুটল।কিন্তু স্ক্রিনে ঋষি নয় ভেসে উঠল দেবেশ মাইতির নাম।কানে লাগিয়ে বলল,হ্যা বলছি।
–ম্যাডাম আগে অনেকবার ফোন করেছিলাম সুইচ অফ।
–হ্যা বলুন হয়েছে?
–হ্যা হয়ে গেছে।
–কোনো অসুবিধে হয়নিতো?
–না না রেজাল্ট ভাল অসুবিধে হয়নি।
–থ্যাঙ্ক ইউ।রাখছি?
ফোন রেখে তৃপ্তিতে ভরে গেল মন।ঋষি এখন কোথায়?নম্বর টিপল,এখনই কিছু বলার দরকার নেই।
ঋষির ফোন বাজতে দেখল জিয়া।হ্যা বল..ঠিক আছে আসছি।
ভজা বলল,বস নতুন ফোন মনে হচ্ছে?আমাকে একটা মিস কল দাও।ভজা তার নম্বর বলল।ঋষি বলল,আজ আসছি।
(চলবে)
0 Comments