গতমাসে আনন্দকে আটটা সিটিং দেওয়া হয়েছে। আম্মাজী বকাবকি করছিলেন। ভুমানন্দ ব্রহ্মানন্দ পরমানন্দ সিদ্ধানন্দকে কি তোমাদের চোখে পড়েনা?পেশেণ্ট আবদার করলেই হল,ছেলেটার কথা একবার ভাববে না?রাগিনী নিজের ভুল বুঝতে পারে,ঠিকই আনন্দের উপর একটু বেশি চাপ পড়ছিল। মিথিলার মনে হল আনন্দকে নিয়ে বেশি ভাবছেন আম্মাজী। কিন্তু সেকথা কাউকে বলার ভরসা হয়না। ওদের সঙ্গে কথা বলে আম্মাজী উপাসনা মন্দিরের দিকে গেলেন।
ফ্লাট বুকিং শুরু হয়ে গেছে। নীচে একটা ঘরে বাবুরাম সিং কনস্ট্রাকশনের অফিস। আল্পনাকে দেখে বাবুয়া উঠে এসে বলল,আসুন ভাবীজী।
–ভাই রান্নাঘর খুব ছোটো হয়ে গেছে।
–দাদা বলল,এ্যাটাচবাথের কথা। সেজন্য কিচেনে একটু ঢুকে গেছে।
–কবে গৃহ প্রবেশ করব?
–হে-হে-হে। সব ঠিকঠাক চললে পুজোর আগেই আশা করছি।
–ঠিকঠাক চললে মানে?
–ভাবীজী দাদাকে বলবেন উকিলবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলতে। ওনার এটীচুট বদলে গেছে, ভাল লাগতেছেনা।
–আমার জমি আমার বাড়ী আমার যা ইচ্ছে আমি করব। এখানে উকিল মোক্তার কি করবে? ভাই-ভাইয়ের ব্যাপার তোদের এত মাথা ব্যথা কেন?বুঝেছি,ওর বউটা মনে হয় কলকাঠি নাড়ছে।
–ঠিক আছে ভাবীজী আস্তে বোলেন,দিবারের ভি কান আছে।
আল্পনার সন্দেহ বেলা চৌধুরীর উপর। মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি। রতিকে নিয়ে কেন
এত আদিখ্যেতা বুঝিনা ভেবেছে?
রত্নাকর উপন্যাস নিয়ে বসেছে। যত পড়ে বদলাতে ইচ্ছে হয়। সোসাইটিতে আগের মত ডাক পায়না। তাই হাতে অঢেল সময়। মোবাইল বাজতে বুঝতে পারে সোসাইটি। কানে লাগিয়ে বলল,আনন্দ।
–সোম?আমি রঞ্জা বলছি।
রত্নাকর ঢোক গেলে রঞ্জা মানে রঞ্জনা সেন?তার নম্বর পেল কোথায়?তুমি বলবে না আপনি? কয়েক মুহূর্ত ভাবে। স্যাণ্ডির কাছে তার নম্বর ছিল খেয়াল হয়। স্যাণ্ডি কি তার নম্বর ডিলিট করেনি?
–হ্যালো সোম শুনতে পাচ্ছো?
–এতদিন পরে কি ব্যাপার?
–খুব জরুরী দরকারে তোমাকে ফোন করেছি। রবিবার আসতে পারবে?
–কি দরকার?
–তোমার কাজের ব্যাপারে,এসো ডিটেলস জানতে পারবে।
রত্নাকর উৎসাহী হয়,একটা কাজ পেলে এসব ছেড়ে দেবে।
–কোথায় সল্টলেকে?
–না না ঠিকানাটা লিখে রাখো।
রত্নাকর একটা কাগজে ঠিকানা লেখে।
–আসছো তো?তোমারই কাজের জন্য।
রত্নাকর ধন্দ্বে পড়ে যায়। একটা চাকরি পেলে পাপ কাজ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
–সোম তুমি আছো?
–হ্যা-হ্যা বলুন।
–কি আসছো তো?
–আমার বাংলায় অনার্স ছিল।
–ঠিক আছে। আসছো তো?
–আচ্ছা। রত্নাকর ফোন কেটে দিল।
রঞ্জনা বড় পোস্টে চাকরি করে। তার চাকরির কথা বলল নাতো?কাগজটা সামনে মেলে ধরে,সদর স্ট্রীট। মিউজিয়ামের পাশের রাস্তা। আজ শুক্রবার তার মানে পরশু। যাবে কিনা ভাবে। সব কথা খুলে বলল না। স্থির করল সোসাইটী হতে ডাক না এলে যাবে। চাকরি তার একটা দরকার। বেলা পড়ে এসেছে,তৈরী হয়ে ভাবল,একবার পাড়াটা চক্কর দিয়ে আসে।
পাড়ায় পৌছে এক চমকপ্রদ খবর শুনল। পঞ্চাদার দোকানে উমাদার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। উমাদার বিয়ে হবে খুশির খবর কিন্তু বিয়ে ঠিক হয়ে গেল অথচ রতি কিছুই জানতে পারে নি?অভিমান হয়। কিছুক্ষন পর উমানাথ এল। রতি কোনো কথা বলেনা। উমাদা গল্প শুরু করে। রতি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
মনীষাবৌদিকে নিয়ে চন্দননগরে বাপের বাড়ী গেছিল। উমাদা বিন্দু বিসর্গ কিছু জানেনা। একটা ঘরে বৌদির দাদার সঙ্গে গল্প করছিল। এমন সময় একটি মেয়ে প্লেটে করে খাবার দিয়ে গেল। কিছুক্ষন পর চা। মেয়েটি খুব লাজুক দেখতে সুশ্রী। আড়চোখে একবার দেখে মুচকি হেসে চলে গেল।
ফেরার পথে ট্রেনে বৌদি জিজ্ঞেস করল,উশ্রীকে কেমন লাগল?
–কে উশ্রী?অবাক হয় উমানাথ।
–ভুলে গেলে? তোমাদের খাবার দিল,চা দিল। উশ্রী রবীন্দ্র ভারতী হতে এম এ করেছে। বিধবা মা, দাদা সামান্য চাকরি করে। বেশি দিতে থুতে পারবেনা।
–এসব আমাকে কেন বলছো?
–বাঃ তোমার বিয়ে তুমি বলবে না কি আমি বলব?
উমানাথ বুঝতে পারল কেন ভদ্রমহিলা মুচকি হেসেছিলেন।
–উফস বৌদি। আমি বললেই হবে?ঐ মহিলার একটা মতামত আছে না?উমানাথ বলল।
–সেসব তোমাকে ভাবতে হবেনা।
–ঠিক আছে আমি কিছুই ভাবতে চাইনা। তুমি যা ভাল বুঝবে করবে।
মনীষা আড়চোখে দেওরকে দেখে বলল,পছন্দ হয়েছে এটাও মুখ ফুটে বলতে পারোনা। তোমাদের ছেলেদের এই এক দোষ।
–ভাল করে দেখলে না বিয়ে ঠিক হয়ে গেল?শুভ জিজ্ঞেস করল।
উমানাথ বলল,একী কুমারটুলির প্রতিমা?বৌদি দেখেছে আবার কি–। একটাই খারাপ ব্যাপার লেখাপড়ায় আমার উপরে।
রতি না তাকালেও কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। একী কুমোরটুলির প্রতিমা–কথাটা ভাল লাগে। উমাদা লক্ষ্য করেছে রতি কিছু বলছে না, জিজ্ঞেস করল,কিরে রতি তুই একেবারে চুপচাপ?
–কি বলব?বিয়ের দিন দেখব কেমন দেখতে হল বৌদি?
উমানাথ পকেট থেকে একটা ছবি বের করে রতিকে দিল। সবাই হামলে পড়ল। রতি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছবিটা দেখল। তারপর অন্যরা ছবিটা নিয়ে নিল।
উমাদা হেসে জিজ্ঞেস করল,কেমন লাগল?
–রঙ চঙা মলাট দেখে বইটা কেমন মন্তব্য করা ঠিক হবেনা।
–একেই বলে লেখক। বঙ্কা ফুট কাটে।
–বালের লেখক। বিরক্তি নিয়ে রত্নাকরের মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল।
সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। কিন্তু রত্নাকর হাসেনা,কতটা যন্ত্রণা থেকে কথাটা রত্নাকর বলেছে সেটা কেউ বোঝেনি।
বাসায় ফেরার সময় উমাদা একান্তে জিজ্ঞেস করে,তুই আর লিখছিস না?
—উমাদা তোমাদের সেই রতি আর নেই। রত্নাকর কেদে ফেলল।
অন্যদের আসতে দেখে উমানাথ বলল,ঠিক আছে পরে শুনবো। চোখ মুছে ফেল।
হোটেলে খেয়ে অটোতে চেপে বসল। উমাদার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ভালই লাগে,বিয়ের পরও কি চ্যারিটির জন্য সময় দিতে পারবে?সবই নির্ভর করে বউ কেমন হবে তার উপর। উমাদাকে ঐসব কথা না বললেই পারতো। সমস্যা তার ব্যক্তিগত এখানে উমাদা কি করতে পারে। এখন লজ্জা করছে। আসলে বঙ্কা যখন তাকে লেখক বলল সেই মুহূর্তে যেন বুকের কোন নরম জায়গায় কথাটা তীরের মত বিদ্ধ হল। মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। রিলিফ সোসাইটিতে গিয়ে তার সারা জীবনের স্বপ্ন বুদবুদের মত ক্রমশ মিলিয়ে যেতে বসেছে। এজন্য কাউকে দায়ী করা যায়না,সেই নিজের পথ বেছে নিয়েছে।
এসব নিয়ে এখন ভাবার কোনো অর্থ হয়না। উমাদার বিয়ে হবে খুশীর খবর। উমাদা বউ নিয়ে সিনেমা যাচ্ছে ছবিটা কল্পনা করে হাসি পেল। সবার সঙ্গে বউ মানায় না। উমাদা মানে কার কি হল কোথায় কি হল দৌড়ঝাপ ইত্যাদি বউ নিয়ে সুখের সংসার উমাদার সঙ্গে খাপ খায়না। অটো থেকে নমে দেখল তিনজন মিস্ত্রি বসে বিড়ি টানছে। রত্নাকর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,তাস খেলছেন না?
–পার্টনার নাই,আপনি খেলবেন?
–আমি খেলতে জানিনা। পার্টনার কোথায় গেল?
–দেশে গেছে,ওর বউ অসুস্থ।
রত্নাকর উপরে উঠে এল। বউ অসুস্থ তাই দেশে গেছে। ওর কেউ নেই,দাদা থেকেও নেই। সংসারে আজ তার কেউ নেই,সে বড় একা। সবাই কারো না কারো জন্য বেচে আছে, মা যখন বেচে ছিল প্রায়ই বলত তোর যে কি হবে তোর জন্য শান্তিতে মরতেও পারছিনা। সকলেই কারো না কারো জন্য বেচে আছে। পরক্ষণে মনে হল, সে কার জন্য বেচে আছে?কে আছে তার এ সংসারে? রত্নাকরের চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
ঠাকুর-পোর কাছে রতির কথা শুনে মনীষার মন খারাপ হয়। সেই রতি আর নেই। কথাটার মানে কি?মা নেই,খোজ খবর নেবার মত কেউ নেই সংসারে। ছেলেটার যে কি হবে,ভেবে দুশ্চিন্তা হয়। কোনো খারাপ সঙ্গে পড়লনা তো?প্রথমদিকে পাড়ায় আসতো না এখন নাকি প্রায়ই আসে ঠাকুর-পোর কাছে শুনেছে। চ্যারিটিতে টাকা দিয়েছে। মনীষা নিজের মনে বলে যারা এভাবে কাদে তাদের মন খুব পরিস্কার।
–আচ্ছা ঠাকুর-পো,তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে অত টাকা কোথায় পেল?
–ভেবেছিলাম করব কিন্তু যদি ভাবে সন্দেহ করছি তাই করিনি।
–তুমি ঠিক করোনি। তুমি ওকে ভালবাসো,ও তোমাকে বিশ্বাস করে,সন্দেহ করলে করত তোমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। জোর দিয়ে বলল মনীষা।
–বৌদি এখন মনে হচ্ছে তুমিই ঠিক,আমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।
–খুশবন্ত ওকে খুব ভালোবাসতো। য়াপন মনে বলে মনীষা।
–ওকে সবাই ভালবাসে। উমা বলল।
মনীষা মনে মনে হাসে ঠাকুর-পো বুঝতে পারেনি তার কথা। মনীষা বলল, বিয়েটা মিটুক। তারপর একদিন তুমি ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি কথা বলব,সে রতি নেই দেখি কি রতি হয়েছে?
বৌদির কথা শুনে হাসল উমানাথ। রতির জন্য বৌদির চিন্তা ভাল লাগে।
উপন্যাসটা নিয়ে বসল রত্নাকর। পড়তে পড়তে আবার উমাদার কথা মনে পড়ে। রত্নাকর ভাবে মনীষাবৌদি বিয়েটা ঠিক করে দিয়েছে। কেউ না কেউ ঠিক করে দেয়। তার তো কেউ নেই। বিয়ের জন্য উপার্জনের সংস্থান থাকতে হয়। তার উপার্জনের সংস্থান কি?নিজে কি করে ভেবে রত্নাকরের শরীর গুলিয়ে উঠল। মনে পড়ল রঞ্জনা সেনের কথা। শুনেছে অনেক বড় চাকরি করেন। মহিলা কি সত্যিই তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবেন? রত্নাকর স্থির করল যাবে। দেখাই যাক কেমন চাকরি,দেখতে দোষ কি?যত ছোটো কাজই হোক তার আপত্তি নেই। না পোষালে করবে না। আম্মাজীর এত ক্ষমতা আম্মাজী কি তার জন্য কিছু একটা করে দিতে পারবেন না?
রত্নাকর আবার উপন্যাসে মনটা ফিরিয়ে আনে। তার উপন্যাসে নায়ক-নায়িকার প্রেমকে বাড়ীর লোকেরা মেনে নিতে পারছেনা। নায়ককে প্ররোচিত করছে নায়িকা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার জন্য কিন্তু এভাবে বিয়েতে নায়কের উৎসাহ নেই। রত্নাকরের সঙ্গে অনেক মেয়ের আলাপ হলেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। পারমিতা ছাড়া প্রায় সকলেরই কারো না কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে। বয়সে কয়েক বছরের বড় হলেও খুশিদিকে ভাল লাগত,বেশ হাসি খুশি। ওর সঙ্গে প্রেম করার কথা কেউ ভাবতে পারত না। হঠাৎ পাড়া ছেড়ে পাঞ্জাবের ফিরোজপুর না কোথায় চলে গেল। যাবার আগে তার খোজে বাড়ীতে এসেছিল,দেখা হয়নি। এখন তার দলে শুধু বঙ্কা,বেচারি চেষ্টা করেও সাফল্য পায়নি।
বই খাতা সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল। বঙ্কার কথা ভাবতে ভাবতে হাসি পেল। কি যেন নাম মেয়েটার?দেখতে আহামরি কিছু নয় কিন্তু পড়াশুনায় ছিল চৌখস। হ্যা মনে পড়েছে মেয়েটির নাম দেবারতি। তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। বঙ্কার তাকে খুব পছন্দ,স্কুল ছুটির আগে রোজ স্কুলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকত। একদিন কি ভুত চেপেছিল কে জানে,চিঠি লিখে মেয়েটির হাতে গুজে দিল। পরেরদিন অনেক আশা নিয়ে বঙ্কা দাঁড়িয়ে থাকে কখন দেবারতি স্কুলে আসে,হয়তো তার হাতে চিঠির উত্তর গুজে দেবে। এক সময় নজরে পড়ল দেবারতি আসছে। বঙ্কা দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে বাচে। কেননা দেবারতি একা নয় সঙ্গে ষণ্ডা চেহারার ভাইটাও ছিল। বঙ্কা আর সেমুখো হয়নি। দেবারতিকে এখন আর দেখা যায়না। অন্য কোথাও চলে গিয়ে থাকবে।
মানুষ যায় আর আসে,সবকিছু এক জায়গায় থেমে থাকেনা। আবার কেউ কেউ গিয়েও ফিরে আসে। দাদা চলে গেছিল ফ্লাট হয়ে গেলে আবার ফিরে আসবে পুরানো পাড়ায়। খুশীদি এপাড়াতে বড় হয়েছে এখন দেশে ফিরে গিয়ে আর পাঁচটা শিখ মেয়ের মত হয়ে একদিন বাংলাটাও ভুলে যাবে। সেও একদিন সরদার পাড়ার পাট চুকিয়ে আবার যতীনদাসে চলে যাবে। জীবন যেন বহমান স্রোতধারা,ভাসতে ভাসতে কার কোথায় গতি হবে কে বলতে পারে?
(চলবে)
0 Comments