পৃথা কিছু বলার জন্য উদ্যত হয়, কিন্তু তার আগেই পাশে রাখা মোবাইলটা বেজে ওঠে... হাতে তুলে নিয়ে দেখে সুশান্ত... ‘ওহ্ ও... একবার অফিসে ফোন করা উচিত ছিল অনেক আগেই...’ সুশান্তর নামটা মোবাইল স্ক্রিনের ওপরে দেখে ভাবে পৃথা... ‘হ্যালো...’
‘আরে, তুমি এখনও অফিসে এলে না? মেট্রোর প্রবলেম নাকি? এদিকে ম্যানেজার বলছিল...’ ওপার থেকে সুশান্তর উদ্বিগ্ন গলা ভেসে আসে।
‘সরি সুশান্ত, আমার আগেই ফোন করা উচিত ছিল, আসলে...’ বলতে শুরু করে পৃথা।
‘কেন কি হয়েছে? আসবে না আজকে?’ প্রশ্ন ভেসে আসে সুশান্তের... ‘কাল তো কিছু বললে না যে ছুটি নেবে বলে... এদিকে...’
‘না, আসলে আমার গতকাল রাত থেকে একটু জ্বর মত হয়েছে, তাই আজকে আর ভাবছি অফিস যাবো না... একটু আজ রেস্ট নিয়ে নিই... কাল চেষ্টা করবো যাবার... তুমি একটু ম্যানেজারকে ইনফর্ম করে দিও না প্লিজ... আমি কাল গিয়ে বরং একটা মেল করে দেবো...’ বলে পৃথা।
‘জ্বর হয়েছে... আরে আমাকে আগে বলো নি কেন? আমি আসবো... ডাক্তার দেখাতে হবে তো...’ ব্যস্ত গলায় উদ্বেগের আভাস পাওয়া যায়।
‘না, না, আমি এখন মোটামুটি ঠিক আছি, ডাক্তার এসেছিল, দেখেছে আমাকে, ওই সামান্য জ্বর শুধু, অসুধ দিয়ে গেছে, কাল মনে হচ্ছে যেতে পারবো...’ তাড়াতাড়ি চেষ্টা করে সুশান্তের উদ্বেগটা কাটাবার।
কানের মধ্যে অর্নব ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, ‘তুমি কথা বলো, আমি একটু আসছি...’
তাড়াতাড়ি করে ফোনটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে পৃথা, যাতে তার কথা সুশান্তের কানে না যায়, সেও ফিসফিসিয়েই বলে ওঠে, ‘না... কোথায় যাচ্ছ... আমার পাশেই থাকো...’ চোখ পাকায় ঘাড় ফিরিয়ে।
‘আরে, আমি আসছি... একটু বাথরুমে যাবো... তুমি কথা বলো না...’ ফের সেই ভাবে বলে ওঠে অর্নব।
‘আচ্ছা... যাও... কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবে... আমি একা থাকবো না... মনে থাকে যেন...’ খাটো গলায় বলে পৃথা।
‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আসবো...’ বলে পৃথাকে টপকে বিছানার অপর দিকে চলে যায় অর্নব... পৃথা শুধু অনুভব করে বিছানার একপাশ থেকে অপর পাশে একটা মৃদু বাতাসের সরে যাওয়া, আর সেই সাথে বিছানার চাঁদরের ওপরে খানিকটা অংশ কুঁচকে যাওয়াটা। ওই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মোবাইলটাকে বুকের ওপরে থেকে তুলে কানে লাগায়... সুশান্ত তখন কিছু বলে চলেছে সম্ভবত।
‘অ্যা? বলো...’ সুশান্তের কথায় মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে পৃথা।
‘কি হলো, হটাৎ করে চুপ করে গেলে, কেউ এসেছে?’ প্রশ্ন করে সুশান্ত।
‘অ্যা... না... ওই কাজল...’ কোন রকমে বলে ওঠে পৃথা।
‘কাজল? সে আবার কে?’ অবাক হয় সুশান্ত।
‘আমার কাজের মেয়ে... আজ থেকেই জয়েন করেছে...’ বলে পৃথা।
‘আরে এই ভাবে হুটহাট কারুকে রেখো না... তুমি এখানে চেনো না শোনো না... এরা খুব একটা বিশ্বাসী হয়না... তোমার লোকের দরকার, আগে বলতে পারতে...’ ফের চিন্তিত হয়ে ওঠে সুশান্ত।
‘আরে না, না, অচেনা নয়... কাজল আগে এই ফ্ল্যাটেই কাজ করতো... খুব ভালো মেয়ে...’ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে পৃথা।
‘তুমি বুঝছো কি করে যে ও ভালো না মন্দ... আগে কখনো ওকে দেখেছ?’ এবার যেন একটু বিরক্তই হয় পৃথার এই রকম একটা হটকারী সিদ্ধান্তে।
মুচকি হাসে পৃথা... যেখানে অর্নব আছে, সেখানে ওর চেনা বা জানার প্রয়োজন কি? ‘না আমার চেনা নয় ঠিকই, কিন্তু প্রণবদার চেনা... উনিই তো আজ সকালে সাথে করে ডাক্তার আর কাজলকে নিয়ে এসেছিলেন...’
‘প্রণবদা... সেটা আবার কে?’ একটু অবাক হয় সুশান্ত।
‘আরে প্রণবদা মানে প্রণব কর্মকার... আমার ফ্ল্যাটের বাড়িওয়ালা...’ বলে ওঠে পৃথা।
শুনে যেন একটু মনোক্ষুণ্ণ হয় সুশান্ত... ‘ওঃ... মিঃ কর্মকার নিয়ে এসেছেন...’ বলে একটু থামে, তারপর প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু উনি তোমার জ্বরের কথা জানলেন কি করে? একেবারে ডাক্তার সাথে নিয়ে চলে এলেন?’
‘আসলে আমিই ওনাকে মেসেজ করেছিলাম আমার জ্বর হয়েছে বলে, তাই উনি সাথে করে ডক্টর নিয়েই এসেছিলেন...’ বোঝাবার চেষ্টা করে পৃথা।
‘হটাৎ আমাকে কিছু না বলে ওনাকে মেসেজ করলে?’ এবার যেন মনোক্ষুণ্ণতাটা আর একটু বাড়ে সুশান্তের গলায়... ‘আমি তো ভেবেছিলাম এই শহরে আমি ছাড়া তোমার নিজের বলতে কেউ নেই...’
‘না, না, আমাকে ভুল বুঝনা, তুমি তো এই শহরে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু... সেটা আমি অস্বীকার করছি না... আসলে...’ বোঝাবার চেষ্টা করে পৃথা।
‘না, সেতো দেখতেই পাচ্ছি... আজকাল অসুস্থ হলে আমার বদলে বাড়ীওয়ালাকে মেসেজ করছ...’ স্বরে একটু রূঢ়তা প্রকাশ পায়।
‘আরে চটছো কেন... আসলে ভাবলাম তুমি অত রাত্রে ঘুমাচ্ছ হয়তো, তাই আর ডিস্টার্ব করতে চাইনি...’ কোন রকলে বোঝাবার চেষ্টা করে পৃথা।
‘পৃথা, আমি ঘুমাচ্ছি বলে তুমি আমাকে মেসেজ না করে বাড়ীওয়ালাকে মেসেজ করছ, কেন উনি কি সারা রাত জেগে থাকেন?’ এবার একটু যেন গলার স্বর চড়ে সুশান্তর।
কি করে বোঝাই তোমায় যে আমি মেসেজটা করিনি, করেছে অর্নব... আমি কি ছাই তখন জানতাম যে অর্নব এই সব কান্ড ঘটিয়ে বসে আছে? মনে মনে ভাবে পৃথা। মুখে বলে, ‘আরে তা নয়... আসলে হটাৎ করে প্রণববাবুর নামটা সামনে পেলাম, তাই ওনাকেই মেসেজটা করে দিয়েছিলাম, তোমার নাম তো ‘এস্’ দিয়ে, তাই ওটা পরের দিকে আসে, তাই না? পরে আমি তোমাকে জানাতামই’ ড্যামেজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে পৃথা।
‘কিন্তু কল্ লিস্টে তো আমার নামটাই থাকার কথা... সেখানে তো প্রণববাবুর নামটা আসার কথাই নয়...’ আরো কিছু বলতে চায় সুশান্ত কিন্তু তার আগেই পৃথা এবার একটু অসুন্তুষ্ট গলাতেই বলে ওঠে, ‘আমি তো বুঝতে পারছি না যে আমি কাকে ডাকবো তা নিয়ে এত কেন কথা উঠছে... আমি তো প্রণববাবুকে ডেকে কোন অপরাধ করি নি... আর তাছাড়া উনি তো এসে আমার উপকারই করেছেন, সাথে ডক্টর পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলেন...’
পৃথার গলার ঝাঁঝে চুপ করে যায় সুশান্ত... তারপর একটু শান্ত গলায় বলে, ‘না, মানে আসলে...’
‘আসলে কিছুই নয় সুশান্ত... তুমি যেটা ভাবছ সেটা নয়... আমার নিশ্চয়ই সেই স্বাধীনতাটুকু আছে, যে আমি আমার বিপদে কাকে ডাকবো আর ডাকবো না...’ একটু একটু করে সে মনে মনে বিরক্তই হয়ে উঠতে থাকে সুশান্ত এই রকম একটা ন্যাগিং নেচারের জন্য। হটাৎ কাঁধের ওপরে হাতের চাপ পড়ে... মুখ তুলে শূন্যের পানে তাকায় পৃথা... কানে আসে অর্নবের খুব খাটো গলা, ‘কুল... মাথা ঠান্ডা রাখো... ভুলো না, ওই ছেলেটি আসলে তোমার শুভাকাঙ্খি... সেই জন্যই এতটা উতলা হয়ে উঠছে... ও কি করে জানবে বলো প্রণব কেমন?’
ওপার থেকে সুশান্তের গলা কানে আসে, ‘সরি... আমারই ভুল হয়েছিল... আসলে তুমি একা থাকো তো, তাই চিন্তা হয়...’
অর্নবের কথায় পৃথার মাথাটাও ততক্ষনে একটু ঠান্ডা হয়ে এসেছে, ‘না, না সুশান্ত, আমিও সেই ভাবে বলতে চাইনি... আসলে তুমিও বোঝ, তখন জ্বরের মধ্যে কাকে কি মেসেজ করেছি, আমিও ঠিক খেয়াল করে করিনি... যাই হোক, তুমি একটু আজ অফিসে ম্যানেজ করে নিতে পারবে তো?’ কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে পৃথা।
‘হ্যা... সে আমি দেখে নেবো... তুমি চিন্তা করো না... তুমি রেস্ট নাও... ডক্টর কি বললেন?’ প্রশ্ন করে সুশান্ত।
‘না, সে রকম কিছু নয়, ওই একটু ঠান্ডা লেগেই জ্বরটা এসেছিল, অসুধ দিয়ে গেছেন, এখন মোটামুটি আগের থেকে ঠিক আছি।’ এবার অনেকটাই ঠান্ডা শান্ত গলায় উত্তর দেয় পৃথা।
‘যাক, তাহলেই ভালো... কিন্তু ঠান্ডাটা লাগালে কি করে?’ প্রশ্ন করে সুশান্ত।
‘কাল ফেরা পথে একটু ভিজে গিয়েছিলাম, তাই বোধহয়...’ উত্তর দেয় পৃথা।
‘কাল ভিজে গিয়েছিলে? কেন ছাতা আনো নি কাল?’ এবার আবার উদবিগ্ন হয়ে ওঠে সুশান্ত।
‘হ্যা, আসলে কাল ছাতাটা ব্যাগে ভরতে ভুলে গিয়েছিলাম, আর ফেরার পথে হটাৎ করে অমন বৃষ্টি নামতে একেবারে ভিজে চান করে গিয়েছি, সেখান থেকেই বোধহয় জ্বরটা এসে থাকতে পারে...’ বলে পৃথা।
‘ইশ... কি করো না তুমি... এই বর্ষার সময় কেউ ছাতা ভোলে... যাই হোক, এখন রাখছি... দেখি সন্ধ্যেবেলায় তোমার ওখানে যাব’খন...’ বলে ওঠে সুশান্ত।
‘হ্যা, হ্যা, এসো না... আর পারলে আসার সময় মৌসুমীকেও এনো না... ভালো লাগবে... অনেকদিন আসে নি ও...’ বলে পৃথা।
‘আবার মৌসুমী কেন... আমিই না হয় আসবো...’ বলে সুশান্ত।
‘কেন? মৌসুমীকে আনতে অসুবিধা কোথায়? মেয়েটাকে অনেকদিন দেখিনিও... ও আসলে ভালো লাগবে...’ জোর করে পৃথা।
‘না, মানে ভাবলাম এখন তোমার শরীরটা খারাপ, তাই শুধু আমি গেলেই...’ বলতে বলতে চুপ করে যায় সুশান্ত।
‘না, না, তুমি এলে আমার অসুবিধা কিছু নেই... কিন্তু তোমার সাথে মৌসুমী এলে আরো ভালো লাগতো, এই আর কি... বড্ড মিষ্টি মেয়েটা...’ সুশান্তের কথার রেশ টেনে বলে ওঠে পৃথা।
কানের মধ্যে অর্নব ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে ফের, ‘এবার ফোনটা রাখো... সবে জ্বরটা ছেড়েছে, এখন ফোনে এত কথা বলা ঠিক নয়... পরে ও এলে না হয় গল্প কোরো...’
অর্নবকে তার প্রতি এমন কনসার্ন হতে দেখে মনে মনে ভিষন খুশি হয় পৃথা, মাথা দোলায় সে, তারপর সুশান্তের উদ্দেশ্যে ফোনে বলে, ‘আচ্ছা, এখন রাখি কেমন, পরে না হয় এলে কথা হবে, এখন আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করছে না...’
ও পাশ থেকে সুশান্ত ব্যস্তমস্ত হয়ে বলে ওঠে, ‘হ্যা, হ্যা, সেই ভালো... পরে দেখা হলেই কথা হবে’খন... আর তুমি চিন্তা করো না, আমি ম্যানেজারকে বলে দিচ্ছি... তুমি রেস্ট নাও...’
‘ওকে, থ্যাঙ্কস্... রাখি...’ বলে আর কথা বাড়ায় না, ফোনটাকে কানের থেকে নামিয়ে কেটে দেয় কলটা... তারপর মুখ তুলে শূন্যের পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘বাবুর কি হিংসা হচ্ছিল, ফোনে অন্য ছেলের সাথে কথা বলছিলাম বলে?’
‘না, না, হিংসার কি আছে, তোমার শরীরটা এখন যথেষ্ট দুর্বল, তাই বারণ করছিলাম, নয়তো আমি বাধা দেবো কেন?’ একটু যেন আহত হয় পৃথার কথায়।
‘আহা, অমনি খারাপ লেগে গেল... দূর বোকা... আমি তো জাস্ট মজা করছিলাম... বরং তুমি বারণ করার সাথে সাথে দেখো ফোনটা কেটে দিয়েছি... কি? ভালো করি নি?’ হেসে বলে পৃথা।
হয়তো উত্তরে অর্নব কিছু বলতো, কিন্তু তার আগেই ঘরে কাজল ঢোকে... ‘একা একা কার সাথে বোকচো দিদিমনি?’ প্রশ্ন করে সে।
থতমত খেয়ে যায় পৃথা... কাজলের কথাটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল সে... তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘দূর... একা একা বকবো কেন? এই তো ফোনেই কথা বলছিলাম...’
‘না, মানে আমার যেন মনে হোলো তুমি হাওয়ার দিকে তাকিয়ে কতা বলচো...’ পৃথার দিকে যেন একটু সন্দিহান চোখেই তাকিয়ে প্রশ্ন করে কাজল।
‘কি দেখতে কি দেখেছিস... ছাড়... কি বলতে এসেছিস বল...’ কথা ঘোরাবার চেষ্টা করে পৃথা।
‘না বলচি সুপটা করেচি... এখানে একসাতেই দু বাটি দিয়ে যাবো না আগে এক বাটি দিই, তারপর তোমার খাওয়া হলে বলবে আমি আর এক বাটি দিয়ে যাবো...’ বলে কাজল।
‘না, না, তুই দুটো বোউলই দিয়ে যা এখানে... আর দুটো চামচও দিস...’ নির্দেশ দেয় পৃথা।
‘কিন্ত এক সাতে দিলে যে ঠান্ডা হয়ে যাবে... তকোন আর খেতে ভালো লাগবে?’ ব্যাপারটা কেমন লাগে যেন কাজলের।
‘সে আমি বুঝবো’খন, তুই দুটো বোউলই দিয়ে যা না... এত গিন্নিগিরি করলে কি করে হয় বলতো?’
‘আমার কি... ঠান্ডা হয়ে গেলে ঠান্ডাটাই খাবে... তকোন কিন্তু আমাকে বলতে পারবে না যে আমি বলিনি...’ পরামর্শ দিতে ছাড়ে না কাজল।
‘আচ্ছা, সেটা আমিই বুঝবো না হয়... তুই দে তো...’ ফের বলে পৃথা।
ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও বাধ্য হয়ে যেন রাজি হয় কাজল, ঘাড় হেলিয়ে বলে, ‘আচ্চা... তাই দিচ্চি...’ বলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে পৃথা।
কাজল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, চাপা গলায় অর্নব বলে ওঠে, ‘আমি কিন্তু তোমার সামনে এই ভাবে খেতে পারবো না...’
‘খেতে পারবে না মানে... ইয়ার্কি নাকি? সেই সকাল থেকে কিচ্ছু খাওনি...’ খাটো গলায় কপট রাগান্বিত ভাবে বলে পৃথা।
‘সেটা নয়... আসলে তোমার সামনে খেতে অসুবিধা আছে...’ বোঝাবার চেষ্টা করে অর্নব।
‘কেন, কিসের অসুবিধা?’ প্রশ্ন করে পৃথা।
‘তুমি বুঝছ না, এই ভাবে আমি কারুর সামনে খেতে পারি না... আমার অস্বস্থি হয়... আসলে ওই রকম ভূতের মত খেতে দেখলে তুমি...’ বলতে বলতে চুপ করে যায় অর্নব।
‘বুঝেছি... কিচ্ছু হবে না... আমি ভয়ও পাবো না, আর খারাপও ভাববো না... তুমি আমার সামনেই খাবে... এতদিন নিজে নিজে যা পেরেছো করেছো... কিন্তু আর নয়... এবার থেকে আমার সামনেই তোমাকে খেতে হবে... আমিই তোমার গার্জেন এখন থেকে... বুঝেছ...’ চাপা গলায় বলে পৃথা।
‘কিন্তু...’ আরো কিছু বলতে যায় অর্নব, কিন্তু পৃথা তাকে থামিয়ে দেয়, বলে, ‘কোন কিন্তু নয়... আমি যখন বলেছি তুমি আমার সামনে বসেই খাবে, তখন তাই খাবে... বুঝেছ?’
আর কোন উত্তর দেয় না অর্নব। এই জেদী মেয়েকে বোঝানোর কম্মো তার নয়, সেটা সে বুঝে গিয়েছে, তাই চুপ করে যাওয়াই শ্রেয় মনে করে সে। ঘরে কাজল ঢোকে একটা ট্রে’তে দু-বোউল স্যুপ আর একটা প্লেটে কড়করে টোস্ট নিয়ে... খাটের ওপরে পৃথার সামনে রেখে বলে, ‘আমি খাইয়ে দিই দিদিমনি?’
ওরে বাবা, তাহলে তো সর্বনাস... মনে মনে ভাবে পৃথা। তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘আরে, না, না, তুই খাওয়াবি কি? আমিই খেয়ে নেবো... তোকে ভাবতে হবে না...’
‘কিন্তু তোমার তো সলিলটা খারাপ, বলো... তুমি কি নিজের হাতে খেতে পারবে?’ উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠে কাজল।
‘হ্যা রে বাবা, ঠিক পারবো... এখন তো ঠিকই আছি... তোকে ভাবতে হবে না... তুই এখানে রেখে যা তো...’ তাকে তাড়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে পৃথা।
‘ঠিক আচে, খাও তাহলে, আমি তাহলে এখানে তোমার কাচেই বসি... কেমন...’ বলে চেয়ারটা টেনে বসার উদ্যগ করে কাজল।
ওকে বসতে দেখে ব্যস্ত হয়ে ওঠে পৃথা, ‘আরে না, না, তোকে এখানে বসতে হবে না, তুই গিয়ে বরং খেয়ে নে... আমি ঠিক খেয়ে নিতে পারবো...’
‘ঠিক আচে তো, তুমি নিজেও খাও না, আমি সুদু একানে বসে থাকবো...’ বলে সত্যিই বসে পড়ে সে চেয়ারের ওপরে।
‘না, না, আমি একাই খাবো... আসলে কেউ সামনে থাকলে আমার খেতে ভালো লাগে না... তুই বরং এখন গিয়ে তোর খাবারটাও খেয়ে নে...’ আপ্রাণ কাজলকে ঘর থেকে তাড়াবার চেষ্টা করে পৃথা... মনে মনে ভাবে, ‘উফ্ কি জ্বালা, প্রণববাবু কি বাঁশটা আমাকে দিয়ে গেল... দিব্বি একা ছিলাম...’
‘সত্তি থাকবো না?’ যেতে ঠিক যেন মন চায় না কাজলের... ‘তোমার খাওয়া হলে ডেকো তা হলে... তোমাকে অসুদ দিতে হবে...’
‘হ্যা, হ্যা, আমি ডাকবো তোকে... চিন্তা করিস না অত... যা, তুইও গিয়ে খেয়ে নে...’ বলে ওঠে পৃথা।
অনিচ্ছা সত্ত্যেও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় কাজল, তারপর আরো একবার পৃথার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘অসুবিধা হলে ডেকো... কেমন...’
মাথা নাড়ায় পৃথা, ‘হ্যা, হ্যা, একটু অসুবিধা হলেই ডাকবো তোকে... চিন্তা করিস না...’
‘কিন্তু তুমি নেমন্ত বাড়ী গিয়ে সবার সামনে কি করে খাও?’ ফের প্রশ্ন করে কাজল।
‘না, মানে সেটা তো নিমন্ত্রন বাড়ী, তাই বাধ্য হয়েই সবার সামনে খাই আর কি, এখানে তো একা, তাই একা একা খেতেই ভালো লাগে...’ আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করে পৃথা।
‘তোমার মায়ের সামনেও তুমি খাও না? ওকানেও বাড়িতে একা একা খাও?’ ফের জিজ্ঞাসা করে কাজল।
‘হ্যা রে, বাড়ীতেও আমি একাই খাই... মায়ের সামনেও খাইনা...’ বাধ্য হয়েই মিথ্যা বলতে হয় পৃথাকে... অথচ সে এখনও এত বড় বয়সেও মায়ের হাত থেকে খেতে পারলে সব থেকে বেশি খুশি হয়।
‘ওওও...’ বলে ব্যাজার মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কাজল... ঠিক দরজার কাছে পৌছে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে, ‘কোন অসুবিধা হলে ডেকো কিন্তু দিদিমনি... আমি রান্নাঘরেই আচি... কেমন?’
মাথা নেড়ে হ্যা বলে পৃথা... কাজলও আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। একটা বড় হাঁফ ছাড়ে পৃথা।
ট্রে’টাকে একটু সরিয়ে রেখে চাপা গলায় বলে ওঠে পৃথা, ‘নাও, এবার খেয়ে নাও...’
‘আমার তোমার সামনে খেতে অস্বস্তি হবে তিতির, তুমি বরং খেয়ে নাও, আমি পরে খেয়ে নেবো...’ আরো একবার বোঝাবার উদ্দেশ্যে বলে অর্নব।
‘এই লোকটা কিছুতেই শোনে না তো...’ বলে চুপ করে পৃথা... সেও বোঝে যে তার সামনে কেন অর্নব খেতে চাইছে না... এই রকম একটা শূন্যের মধ্যে খাবারগুলো ঢুকে যেতে দেখলে ওর অদ্ভুত লাগতে পারে, আর সেই জন্যই অর্নবের এত অনিহা ওর সামনে খেতে। তাই শেষে ও বলে, ‘ঠিক আছে, তোমাকে আমার সামনে খেতে হবে না, এক কাজ কর, আমি ট্রে’টাতে তোমার স্যুপটা আমার পাশে দিয়ে দিচ্ছি... আর আমি তোমার দিকে পেছন করে বসছি... তুমি খাও, আমি তাকাবো না... তাহলে হবে তো?’
আর কিছু বলে না অর্নব... পৃথাও বোঝে এতে কাজ হয়েছে... নিজের বুদ্ধিমত্তায় মুচকি হাসে সে... তারপর নিজের স্যুপের বোউলটা আর দু-পিস টোস্ট তুলে নিয়ে ট্রে’টাকে ওর একটু পেছন দিকে ঠেলে দেয়। মন দেয় নিজের খাবারে... একটু পর কানে আসে বোউলের সাথে চামচের টুংটাং আওয়াজ। মনটা খুশিতে ভরে ওঠে তার।
ক্রমশ...
0 Comments