আশাপূর্ণা


কাহিনীর নায়ক তেরো বছরের ।  স্কুলে পড়ে । ক্লাস সেভেন । নাম সাগর । নায়িকা তিরিশ বছরের । বিবাহিতা তরুণী । নাম শুক্তি ।  এই উপন্যাসটির ব্যাপারে পরে জানাচ্ছি । এই অসম্ভব প্লট নিয়েও যিনি কালজয়ী প্রেমের  উপন্যাস রচনা করতে পারতেন তিনি আশাপূর্ণা দেবী । অত্যন্ত বলিষ্ঠ কলম তাঁর । প্রেমেন্দ্র মিত্র আর সজনীকান্ত দাস বলেছিলেন ' এ পুরুষের কলম ' ।  শুধুমাত্র মেয়েদের রান্নাঘরে আবদ্ধ রাখেননি তিনি । তাঁর প্রতিটি নারী চরিত্র স্বতন্ত্র । স্বকীয়তায় উজ্জ্বল ।

১৯০৯ - ২০১৯ ..... একশো দশ  বছর পার করলেন আমার আপনার সবার প্রিয় আশাপূর্ণা দেবী ।
আশাপূর্ণা গুপ্ত । বিয়ের পরেও তাই । গুপ্ত পদবী ।

তাঁর প্রথাগত শিক্ষা ছিল না তো ..... তাহলে  এত এত উপন্যাস , গল্প , চরিত্র তিনি আঁকলেন কি করে ?

তিনি বলেছেন " আমি মনের জানলা খোলা রেখেছিলাম যে " .....

তিনি ভারতের প্রথম মহিলা হিসেবে সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পান । অথচ অদ্ভুত সত্যি কথা হল তিনি কোনোদিন স্কুলে পড়েননি । হ্যাঁ এটাই সত্যি । তাঁদের বাড়ির বারণ ছিল । তাঁর মা কিন্তু স্কুলে পড়া বিদুষী ছিলেন ।আশাপূর্ণা দেবীর মা সরলাসুন্দরী দেবী খুব চেষ্টা করেছিলেন তাঁর মেয়েরা স্কুলে পড়ুক । কিন্তু তাঁর শাশুড়ির অনমনীয় জেদের কাছে হার মেনে যান । আশাপূর্ণা দেবীর  ঠাকুমা শেষমেশ মত দেননি । তিনি আজীবন আফসোস করেছেন এই
একটি বিষয়ে । স্কুলের মুখ দেখেননি বলে ।

 আশাপূর্ণা দেবীর সাথে তাঁর  বৌমা নূপুর গুপ্তর অদ্ভুত সুন্দর সম্পর্ক ছিল । প্রতিটি বইয়ের ভূমিকা লেখেন তাঁর বৌমা ।  তিনি ঘরোয়া আশাপূর্ণাকে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করে গেছেন ।
               নূপুরদেবী বলেছেন  - " আমি এত মানুষ দেখেছি , কিন্তু আমার শাশুড়ির  মত সমস্ত সংকীর্ণতা ছাপিয়ে উঠতে আর একজনকেও দেখলাম না ।
                মা টানা লিখতে পারতেন না , কেউ না কেউ দেখা করতে আসতো । যেমন একদিন পুরোনো ঝি এসেছে , মা কুড়ি টাকা দিলেন , খানিক গল্পসল্প করে বিদায় দিয়ে আবার লিখতে বসলেন এরকম । "
                যে উপন্যাসের  কথা ভূমিকায় লিখলাম , সেই কাহিনীর নাম শুক্তি - সাগর । সাগর ক্লাস সেভেনে পড়ে । শুক্তি বিবাহিতা । স্বামী ননদ নিয়ে সংসার । ছেলে - মেয়ে হয়নি । সাগর রোজ শুক্তির বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে আসতো - যেত । ঐভাবেই কখন যে শুক্তি মন দিয়ে ফেলে কে জানে !

তবে এ গল্পে এতটুকু অশালীনতা ছিল না ।

সেটা রাখতে চাইলে তিনি ছেলেটিকে নিদেনপক্ষে আরেকটু বড় বয়সের দেখাতেন । কিন্তু তাঁর কলমের মুন্সিয়ানাই আলাদা ।
           সাগরকে ডেকে ডেকে স্কুল ছুটির পর চপ - কাটলেট খাওয়াতো শুক্তি । আর বলে দিয়েছিল ,
আমায় ' কিছু নয় ' বলে ডাকবি । আমার নাম '  কিছু নয় '  , এ সম্পর্কের নাম ' কিছু নয় '  । ক্লাস সেভেনের ছেলেটি খুব লাজুক টাইপের ছিল । তার পক্ষে এই প্রেমের  জগৎ বোঝা সম্ভব নয় । বোঝেওনি । সে শুধু আদর যত্ন মমতা টুকু বুঝতো । সম্পর্কের গভীরতা তো বুঝেছিল অনেক অনেক পরে । যখন সাগর লেখক সংবরণ চৌধুরী । আর শুক্তি তখন  ইহজগতে নেই । কোথাও নেই । শুক্তির মনে কোন পাপ ছিল না , সে ভালোবেসে ফেলেছিল সাগরকে । নিখাদ , নিষ্পাপ ভালোবাসা ।
           জ্যাঠা - জেঠিমার আশ্রয়ে  থাকত সাগর , সাগরের মা ও বোন । বাবা নেই যে সাগরের ।  তবে স্কুল ছুটির পর এই ছেলেটিকে বাড়িতে ডাকা নিয়ে তবু নিন্দের ঝড় উঠেছিল । শুক্তি তাঁদের প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে , সাগরদের বাড়িতে বারবার  এসে  হেসে , গল্প করে  সম্পর্ক সহজ করে নেয় ।  তবুও অনেকের কত কটূক্তির শিকার । ননদ বারবার বলতো ওকে ভাইয়ের মত বা ছেলের মত বললেই ল্যাঠা চুকে যায় । শুক্তি একবারও বলেনি সাগর আমার ছেলের মত বা ভাইয়ের মত । আশ্চর্য দৃঢ়তা শুক্তির ।  শুধু উদাস হয়ে বলত , ও ' কিছুনয় । '
             সাগর আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল । ম্যাট্রিক ভালোভাবে পাশ করল , শুক্তি ভালো ভালো মাস্টার রেখে দিয়েছিল যে । এরপর ইলেভেনে উঠল ..... শুক্তি ক্রমশঃ বুঝতে পারছিল , এ সম্পর্কের কোনো পরিণতি নেই ।
শুধুই একতরফা ভালোবাসা । বয়সের যদি এই দুস্তর ব্যবধান না থাকতো ......

               শুক্তি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে । সাগরের জন্য লিখে রেখে যায় একটা বড় চিঠি । তাতে লেখা ছিল , আমি খানিকটা  হুবহু লিখছি আশাপূর্ণা দেবী যা লিখে গেছেন ,
" মরছি কেন জানিস ?
বেঁচে থাকলে কোনো দিনও তোর চাইতে ছোট হতে পাব না বলে !
তুই চলতে চলতে এসে আমাকে ' বুড়ি ' ছুঁবি , একবার থমকে দাঁড়াবি , ভাববি ' তাইতো ' ! .....
তারপর আরো এগোতে থাকবি , আমাকে ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে এগিয়ে যাবি । ..... অনেক বড় হয়ে যাবি । তখন তো -- তোর আমাকে " ছেলেমানুষ " বলে একটু মায়া হবে ? তখন তো কোনো দিনও আমার কথা ভাববি ?

তারপর তো ভেবেই গেছে সাগর । সাগরের আর বিয়ে করা হয়নি । একটা মুখ , একটা নাম চিরকালের জন্য হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল । সাগর এখন প্রৌঢ় ।  প্রতিদিনই ঘুমোনোর আগে সঙ্গী বলতে এলকোহলের গ্লাস আর একটা ছবি । শুক্তির । উপন্যাসের  শেষটা ছিল এরকম -- "   যা দেখলে মমতায় বুক ভরে ওঠে । যা দেখলে হঠাৎ অবাক হয়ে গিয়ে মনে হয় ----- আশ্চর্য !   আমি একে অত বড় ভাবতাম কেন ? " 

এই পোস্টে উপন্যাসের বৈচিত্র্য লিখি নাকি ওনার বৈচিত্র্যময় জীবন লিখি বুঝতে পারছি না । বড় পোস্ট আজকাল আর কেউ পড়তে চান না ।

আর একটি উপন্যাস - অনবগুণ্ঠিতা । সেটির কিন্তু প্রায়  মিলনাত্মক অবস্থান । চম্পা আর চন্দ্রভূষণের কাহিনী । চন্দ্রভূষণ রাজশাহীতে মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে । চম্পাও ওই বাড়িতেই থাকে । অনাথ । চন্দ্রর মামীর বোনের মেয়ে । দুজনেই দুজনকে ভালোবাসে । কিন্তু প্রকাশ নেই সে ভালোবাসার । দুজনের ছেলেবেলা তখন । চম্পা তখন স্কুলের শেষের দিকে  । আর চন্দ্র কলেজে । চম্পা একটু অবোধ টাইপের । মেলা দেখতে গিয়ে জামিলের বদমাইশিতে বিক্রি হয়ে যায় । যখন আবার দেখা হয় দুজনেই প্রায় প্রৌঢ় । চন্দ্র বিয়ে করেননি । ভাইদের সংসারই তাঁর সংসার । চম্পাকে রেলগাড়িতে আবিষ্কার করেন এবং একটি ভাড়া বাড়িতে রেখে দেন ।
রোজ সন্ধ্যেবেলা চা খেতে যান আর ভাবেন চম্পাকে কি কোনোমতেই আমার নিজের  বাড়িতে নিয়ে আসা যায় না ? আর ভাবেন -- ' আমি সমাজ সংস্কার মানি না । ওকে স্বীকৃতি দেব । আমি বাড়িতে আনবোই চম্পাকে ।

চম্পার মত নেই । বলে এই বেশ ভালো আছি ।
চন্দ্রভূষণের ইচ্ছা নয় চম্পাকে নিয়ে অন্যত্র সংসার পাতার । কারণ ওই বাড়ি ।
ওই পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে তিনি নড়বেন না ।
বাড়ির সবাই , ভাইয়েরা সব জানতে পেরে হাঁড়ি আলাদা করে নিল , তবু একবারও জিজ্ঞেস করল না   --  "  দাদা উনি কে ? "
চন্দ্রভূষণ একদিন অনেক রাত্তিরে এলেন চম্পার বাড়িতে । জ্বরে বেহুঁশ । চম্পা সেই রাতেই ভাবতে বসে ...... চম্পার ভাবনা আমি লেখিকার কলমে তুলে ধরছি ,
" চম্পার সংস্পর্শে এই মানুষটা অশুচি হয়ে যাবে কেন ? চম্পা কি নিজে অশুচি ? চম্পার উপর যদি একটা হিংস্র বাঘ তার থাবা বসাতো , চম্পা কি তার শুচিতা হারাতো ? আর এই মানুষটার আজীবনের একনিষ্ঠ ভালোবাসা ? তার কোন মূল্য নেই ? "

চম্পা চন্দ্রভূষণের ভার নেয় । লুকিয়ে নয় তবে । অসুস্থ চন্দ্রভূষণকে নিয়ে  ওই বাড়িতেই আসে ।
সবাইকে বলে " আমি বাড়ির বড়বৌ , তোমাদের বড় ভাজ ।  ডাকাতে লুঠ করে নিয়ে গিয়ে ভারী ভুগিয়েছে অনেকদিন । তোমাদের সঙ্গে তো চেনাজানাই হয়নি । "

গভীরতর উপলব্ধি লেখিকার , মেয়েমানুষকে ওরকম মাছ দুধের মত নষ্ট হয়ে গেছে বলে দেগে দেওয়া যায় না । 

আশাপূর্ণা দেবীর প্রথাগত শিক্ষা নেই তো কি আছে ?
শেষজীবনে ডিগ্রির অভাব হয়নি । পুরস্কারের অভাব হয়নি । সম্মানসূচক ডক্টরেট পেয়েছিলেন ,
জব্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয় ( ১৯৮৩ ) , রবীন্দ্র - ভারতী ( ১৯৮৭ ) , বর্ধমান ( ১৯৮৮ ) , বিশ্বভারতী ( দেশিকোত্তম ১৯৮৯ ) , এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী স্বর্ণপদক পেলেন ১৯৯৩ সালে ।
বিখ্যাত উপন্যাস ট্রিলজি  -- প্রথম প্রতিশ্রুতি , সুবর্ণলতা ও বকুলকথা । এর মধ্যে প্রথমটির জন্য তাঁর হাতে জ্ঞানপীঠ উঠে আসে ।

মায়ের উৎসাহে পড়াশোনা । ওই বাড়িতেই । মায়ের উৎসাহেই '  শিশুসাথী ' পত্রিকায় প্রথম কবিতা পাঠানো । আশাপূর্ণা দেবীর মতে  সম্পাদকদের উৎসাহমূলক চিঠিগুলো ' আরো পাঠাও , আরো লেখো 'ই তাঁর আসল অনুপ্রেরণা । তাঁর তো তখন মাত্র তেরো বছর বয়স । তাই সম্পাদকদের তুমি করে সম্বোধন ।

অনেককিছু লেখা হল না । কারণ পোস্ট লম্বা হয়ে যাচ্ছে । তাঁর মা সরলাসুন্দরীর শিক্ষা - দীক্ষা রুচি উদারতা  । যা কিনা তিনি মেয়েকে দিয়ে গিয়েছিলেন । পিতা হরেন্দ্রনাথ গুপ্তর সংগীত ও চারুশিল্পে প্রতিভা । স্বামী কালিদাস গুপ্তের আজীবন সহৃদয়তা । তাঁরা কয় ভাইবোন , বিয়ের পরে সংসার কেমন ছিল ।
সবই লিখব তাঁর মৃত্যুদিনে । ১৩ই জুলাইতে ।

লাস্ট কথা , বাংলার অনেক তাবড় তাবড় লেখক আশাপূর্ণা দেবীর জ্ঞানপীঠ পুরস্কারের  নমিনেশন আটকে দিতে চেয়েছিলেন । তিনি যাতে না পান , কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই বাংলায় এম . এ , বি এড বা ডবল এম এ এরকম । আর আশাপূর্ণা দেবীর কোন ডিগ্রি নেই !
কালি - কলম - মন লেখে তিনজন । এর বাইরে কোন কথা নেই বোধহয় । ফেসবুকে লিখে কত মানুষের বই হচ্ছে । মানুষের উৎসাহেই তো জন্ম নেয় ছাইচাপা প্রতিভারা ।
নবনীতা দেবসেন , প্রতিভা বসু , মহাশ্বেতা দেবী , লীলা মজুমদাররা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন । বলেছিলেন , ' প্রথম প্রতিশ্রুতি' র জ্ঞানপীঠ পাওয়া উচিত কারণ এই উপন্যাস  নারী স্বাধীনতার এক জ্বলন্ত দলিল ।

কে বলে মেয়েরা মেয়েদের শত্রু হয় ?


© Soma de chowdhury .

Post a Comment

0 Comments