সব শোনার পর থেকে রমনা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল. সন্তুর ভালবাসা জীবনে পেল না. আর রান্তাকে ভালবাসার জন্যে জীবনটাই শেষ হয়ে গেল সন্তুর. অতনু রমনাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করলো. কি বা সান্তনা দেবে. নিজের বুকের কষ্টই চেপে রাখা যায় না.
বেশ খানিক পড়ে রমনা শান্ত হলে বলল, “তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?”
অতনু বলল, “অনেক কাজ ছিল সেগুলো মেটালাম. দাদা ওই মেয়েটিকে বিয়ে করেছিল. বৌদির নাম ছিল সুপ্রীতি. যখন দাদাকে ছেড়ে সুবোধরা চলে গেল তখন দাদা ওখানে ছিল. ঘটনার অকিস্মিকতায় ও বিহ্বল. ওর এডস হয়েছে জেনে ভেঙ্গে পড়ল না. এখানেই বোধ দাদার সাথে আর পাঁচ জনের পার্থক্য. হোস্টেলে ফিরে গেল. আমি এখানে স্কুলে পড়ছিলাম. সেখান থেকে আমাকে সরিয়ে নিয়ে গেল. দাদার সন্দেহ হচ্ছিল যে আমার জীবনও ওরা শেষ করে দিতে পারে. আমাকে দেহরাদুনে কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করে দিল. আমাকে সব বুঝিয়ে বলল. কি ধরনের বিপদ হতে পারে. ঠাকুরদা, ঠাকুরমা সব জানলেন এবং দাদার কাজের কিছু বিরোধ করলেন না. আমাকে বলে দিয়েছিল যেন আমি নিজের বাড়ি, বা বাবার মারা যাবার কারণ এগুলো ঠিক করে না বলি. দাদার পড়া শেষ হয়ে গিয়েছিল. আর পড়া শেষ হবার আগেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিল. তাই দাদার বিয়ে করতে কোনো অসুবিধা ছিল না. যে রোগ বাঁধিয়ে ছিল তাতে যে বেশি দিন বাঁচতে পারবে না. ওই মেয়েটিকেই বিয়ে করেছিল. দাদা ভালোবেসে বৌদিকে বিয়ে করে নি. নিজের সমব্যথী পাবার জন্যে করেছিল. মেয়েটির অবস্থা বড্ড খারাপ ছিল. বৌদি বেশি দিন বাঁচেও নি. রোগ হবার জন্যে ও নিজে থেকেই খদ্দের নিতে চাইত, তার ওপর যারা ওর রোগের খবর জানত তারা ওর কাছ ঘেঁসত না. ফলে ওর টাকা ছিল না. সুবোধ অনেক টাকার লোভ আর ভয় দেখিয়ে ওকে দাদার সাথে সেক্স করাতে রাজি করেছিল. যৌনপল্লীতে অনেক দালাল থাকে. তারা অনেক নোংরা কাজ করে পয়সার জন্যে. তাদের দিয়েই সুবোধ এডসওয়ালা যৌনকর্মীর খোঁজ নিয়েছিল আর ব্যবহার করেছিল. দাদা চাকরি পেয়ে কয়েক দিন চাকরি করলো. নামী ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভারসিটি থেকে পাশ করাতে অনেক মাইনে পেত. সেই টাকায় ও বৌদির চিকিত্সা করা ছাড়াও ওই এলাকার অনেক ভালো কাজ করিয়েছিল. তাছাড়া টাকার অভাব দাদার ছিল না. ওর নামে অনেক টাকা আগে থেকেই জমানো ছিল. সেটা খরচ করত. সরকারের যা কর্তব্য তা করে না বা করতে পারে না. কিন্তু তার জন্যে আমরা মানে জনসাধারণ ভুগি. আর সেটা নিষিদ্ধ পাড়া হলে তো কথায় নেই. চারিদিকে নোংরা. জলের ভালো ব্যবস্থা নেই. ছোট বাচ্ছারা স্কুল যায় না. এরকম অনেকগুলো কাজ দাদা নিজের উদ্যোগে করেছিল বা করার চেষ্টা করেছিল. লোক লাগিয়ে নোংরা জায়গা যতটা পারা যায় পরিস্কার করেছিল. ওর এক বন্ধুর মা NGO চালাতেন. তাকে বলে ওখানের বাচ্চাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিল. ফলে দাদাকে ওখানের লোকজন আপন মনে করত, ভালবাসত. যারা দাদার সর্বনাশ করতে সুবোধদের সাহায্য করেছিল তারা লজ্জা পেল এবং ক্ষমা চাইল. আমার ১০ ক্লাসের পরীক্ষা হয়ে যাবার পড়ে দাদা আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেল. ততদিনে আমি বেশ বড় হয়ে গেছি. দাদা আমাকে সব কিছু খুলে বলল. তোমার কথা, বাবা মায়ের কথা, খোকাইয়ের কথা, সুবোধের কথা, সুপ্রীতি বৌদির কথা. তারপরে তোমাকে সুবোধের খপ্পর থেকে উদ্ধার করার জন্যে আমাকে কাজে লাগলো. দাদার বিশ্বাস ছিল যে যদি জানতে পারে যে খোকাই ওর ছেলে নয় তাহলে রান্তা আর খোকাই দুইজনেরই ভীষণ বিপদ. সুবোধ পারে না এমন বাজে কাজ নেই. সুবোধ জানত না যে খোকাই ওর ছেলে নয়. নিজের ওপর একটা নির্বোধ অহংকার ছিল. দেখে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু ও যে কত বড় হার বজ্জাত!!! বাসু যে সুবোধের দোকানের কর্মচারী.. তার কাছে থেকে দাদা খবর পেত. বাসু আগে বাবার সময়েই কাজ করত. ওর ওপর সুবোধ ভরসা করত. আর ভরসা করত নিতাইয়ের ওপর. বাসুদা সেই ভাবেই চলত যেভাবে চলে সুবোধ সন্তুষ্ট থাকবে, ওর ওপর সুবোধের কোনো সন্দেহ থাকবে না, নিশ্চিন্তে দাদাকে প্রয়োজনীয় খবর পাচার করবে. বাসুদা বাবার মৃত্যু মেনে নিতে পারে নি. ও নিশ্চিন্ত ছিল যে এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত খুন. এটার বিহিত হোক. তাই সে সুবোধের কাছে থেকে ওর সর্বনাশের চেষ্টা করছিল.
বাসুদা মালতির কাছে থেকে তোমার খবর নিত. আর যখন সুবোধের জন্যে দুপুরের খাবার আনত তখন তোমার অবস্থা দেখতে পেত. সেই মত দাদাকে সব জানাত. তোমাকে দাদার খবর বলত না. কোনো কারণে তোমাদের সাথে মানে, বাসুদা, তুমি বা মালতির সাথে যোগাযোগ আছে জানলে তোমাদের বিপদ হতে পারত. ছোটবেলা থেকেই আমার সাহস অনেক বেশি. তোমার সাথে দেখা হবার আগে শেষ যেবার দাদা মাসির বাড়ি মিকুনি গিয়েছিল সেবার আমি আর মাও গিয়েছিলাম. সেবার আমাকে সাপে কামড়ে ছিল. আমি কোনো রকম ভয় না পেয়ে সটান জানিয়েছিলাম যে সাপে কামড়েছে. তখন সুজয় বলল কোথায়? আমি বললাম কলের পারে. সাপটা তখন ছিল. সুজয়দা দেখে বলল, ও ধোড়া সাপ কিছু হবে না. কিছু হয় না সে সবাই জানে. সাপের কামড়ে বিষক্রিয়ার থেকে আতঙ্ক-ক্রিয়া কিছু কম না. হইচই তো হয়ই. কিন্তু ওই রকম বছর আটেকের ছেলে যদি কান্নাকাটি না করে স্বাভাবিকভাবে জানায়… সেটা সাহস দেখানোর পরিচয় বটে বৈকি. আর কিছু ঘটনা ঘটে যা থেকে দাদা সমেত বাড়ির সবার ধরনা হয়েছিল যে আমি সাহসী. দাদা পুরো পরিকল্পনা করেছিল যাতে আমি সুবোধকে শাস্তি দেব বা তোমাকে ওর থেকে বিচ্ছিন্ন করব. তোমার সাথে যা আমি করেছি সেটা প্রথমত পরিকল্পনা মাফিক হয়েছিল. আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে তুমিও না জেনে এই ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে গেছ. কিন্তু আস্তে আস্তে তোমাকে যখন জানলাম তখন না ভালোবেসে পারিনি. দাদা সত্যি একই সাথে ভাগ্যবান আর দুর্ভাগ্যবান. তোমার প্রথম প্রেম দাদা… তাই সেই ভাগ্যবান. যে অত্যন্ত সৎ প্রেমিকা হিসেবে. যে তার প্রেমিকের ভিতুদিক না দেখে প্রেমিকের কথা মত তাকে ছেড়ে দেয়. আর দুর্ভাগ্যবান যে তোমার সাথে বাকি জীবন কাটাতে পারল না. দাদার কোনো পরিকল্পনায় ছিল না যাতে তোমার কোনো অসম্মান হয় বা কষ্ট হয়.
মালতি তোমার কাজের মাসি. কিন্তু সে অত্যন্ত কাজের লোক ছিল আমাদের জন্যে. তোমাকে উত্তেজিত করার জন্যে ওকে অনেক মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে. আমি তার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি. এটা সত্যি যে মালতির ছেলে দুটো পড়াশুনায় খুব ভালো. তার জন্যে ওদের অনেক টাকা দরকার. তাছাড়া আর কোনো কিছু সত্যি নয়. আসলে ওর কোনো দেওর নেই. ফলে যেসব গল্প তোমাকে বলত সেগুলো শুধুই গল্প. শুধু তোমাকে উত্তেজিত করার জন্যে. অনেক দিন ধরে তোমাকে বলে বলে একটা না পাওয়ার কথা তোমার অবচেতন মনে গেঁথে দিয়েছিল. ওই ছিল তোমার একমাত্র বন্ধু যাকে অনায়াসে অনেক কিছু বলতে পারতে. তোমার না পাওয়া. স্বামীর সান্নিধ্য ছাড়া জীবন. এগুলো আমাদের পাচার করত মালতি. তার জন্যে অবশ্য ওকে পয়সা দিয়েছে দাদা. ওর ছেলেদের পড়ার খরচ সব আমাদের. তোমার সাথে আমার প্রথম সাক্ষ্যাত যেটা হয়েছিল তার জন্যে অনেকটাই মালতি দায়ী. ওই বলেছিল তোমাদের জলসা দেখতে যাবার কথা, তুয়ার জন্মদিনের কথা. অবশ্য কেন এসব তথ্য নিতাম তা জানত না. তোমার সাথে যে আমার শারীরিক সম্পর্ক ছিল সেটা ও জানত না. আর বাসুদা খবর দিত ওর ব্যবসা সংক্রান্ত. সব থেকে বড় বজ্জাত ছিল নিতাই. সুবোধের সোনার ব্যবসা পেয়েই ওর খিদে মিটে যায়. ও সত্যিই সোনার কারবার ভালবাসত. কিন্তু তার জন্যে কাউকে খুন করা কখনই ঠিক নয়. তাই ও যখন দোকানটা পেয়ে গেল তখন ও ওটা নিয়েই মেতে থাকলো. ও তার উন্নতি করলো. নিতাই যে, আমার ধরনা, সুবোধের পাপের মধ্যে জড়িত ছিল সে শুধু ভোগ করে গেল. কোনো দায়িত্ব নেই. শুধু ভোগ. থাকত ড্রাইভার হয়ে. কিন্তু ছিল রাজার চলন. আমাদের সোনা ছাড়াও আরও অনেকগুলো কারবার ছিল, তাই সুবোধ যখন ওটা দখল করে নিল আমদের আর্থিক অবস্থার কোনো হের ফের হয়নি. আর আমাদের সৌভাগ্য যে অন্য কোনো ব্যবসা থেকে আর কোনো সুবোধ বেরয় নি. তাহলে শেষ হয়ে যেতাম. অন্য ব্যবসা যাদের দায়িত্ব ছিল তারা সময় মত টাকা দিয়ে যেত. বাবা মায়ের মৃত্যুর ধাক্কা কাটাতে ঠাকুরদার অনেক সময় লেগেছিল. সেটা সামলানোর পরে ঠাকুরদাই ব্যবসা চালাতেন. আর বাড়ান নি, বরঞ্চ কিছু কমিয়ে দিয়েছেন. ওই টাকা থেকেই নিতাই ফুটানি মারত. ঠাকুরদা, ঠাকুরমা বয়সের জন্যে নিতাইয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন. ওই সব দেখত আর ভোগ করত. নিতাইকে দাদা কাজ থেকে ছাড়াতে পারে নি.”
রমনা বলল, “আচ্ছা আমার একটা জিগাস্য আছে. যদি জানতেই যে সুবোধ আর নিতাই মিলে তোমার বাবা মা কে খুন করেছে, তবে পুলিসের কাছে গেলে না কেন?”
অতনু বলল, “খুন করেছে তার কোনো প্রমান আমাদের কাছে ছিল না. যে ড্রাইভার ছিল সেও মারাত্বক জখম ছিল. তার মানে সে যে দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েছিল সেটা ঠিক. এমন এক্সিডেন্ট যেখানে ষড়যন্ত্রকারীর জীবন বিপন্ন এমনকি জীবনহানির মত অবস্থা হয় সেখানে তার বিরুদ্ধে খুনের মামলা করা কঠিন ছিল. সুবোধের ওই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কোনো প্রমান পাই নি. ঠাকুরদা, ঠাকুরমা এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে তাদের পক্ষে সেই সময়ে কিছু করা সম্ভব ছিল না. আমি ছোট ছিলাম. ধর্তব্যের মধ্যে ছিলাম না. দাদা যে কেন কিছু করে নি জানি না. হয়ত সুবোধ তোমার স্বামী,
(চলবে)
0 Comments