ছেলেটা একটা কিছু দেখে বলল, ‘স্যার, কোলকাতার ফ্লাইট সকাল সাড়ে এগারোটায়। আশা করি ওতে পেয়ে যাবো। জানতে পারি কি স্যার কি প্রব্লেম?’
আমি বললাম, ‘তুমি জানতে পারো, কিন্তু আমি বলতে পারি না। বললেই আমি দুর্বল হয়ে যাবো। তুমি ভাই প্লিস ব্যবস্থা করো।‘
আমি দৌড়ে উপরে এলাম। দরজা ঠেলে ঢুকতেই দরজা খুলে গেল। মনে পরে গেল আমি দরজাটা জাস্ট ভেজিয়ে গিয়েছিলাম। দূর থেকে ওদের নগ্ন শরীর চোখে পড়লো। ভাগ্যিস কেউ এসে যায় নি। দরজাটা বন্ধ করে আমি বিদিশার কাছে গেলাম। ও নগ্ন হয়ে দু পা ফাঁক করে শুয়ে রয়েছে। আমার নজর দেবার ইচ্ছে হচ্ছে না। ওদের ডাকতে হবে বলতে হবে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে।
যদি ওরা জিজ্ঞেস করে এতো তাড়াহুড়ো কিসের? তাহলে আমি কি জবাব দেব?
বলতে পারবো না মিতার কথা। আমার জন্য ওরা জীবনের সুখ নষ্ট করুক আমি চাই না। আমি জীবনের সুখের কিছু সময় নাহয় মিতার জন্য ব্যয় করবো। জানতে পারলাম সুখের পিছনে দুঃখ লুকিয়ে থাকে আর একটা সময় সেটা বেরিয়ে আসে কান্না হয়ে।
বিদিশাকে ডেকে তুললাম। বিদিশা উঠে বসে আমাকে দেখে বলল, ‘গৌতম তোমাকে কেমন জানি উদভ্রান্তের মত লাগছে। রাতে ঘুম হয় নি?’
আমি বিদিশাকে বললাম, ‘না না বিদিশা তা নয়। আমাদের কোলকাতা পৌছতে হবে শীগগির। অফিসে একটা খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। আমাদের কোম্পানি এতে প্রায় একশ কোটি টাকা লস করতে পারে। আর আমি ছাড়া কেউ নেই। সকালে বসের ফোন এসেছিল। বলল তাড়াতাড়ি চলে আসতে। আমি নিচে প্লেনের টিকিট কাটতে বলে দিয়েছি। সকাল সাড়ে এগারোটার প্লেন। আমাদের তৈরি হতে হবে তাড়াতাড়ি।‘ সব কিছু বলে ভাবলাম উফ ভগবান মিতার জন্য একটুও সত্যি কথা বলতে পারবো না?
বিদিশা ধরফর করে বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘উফ বাবা তোমাদের অফিস বটে। সব কাজ তোমাকেই করতে হবে নাকি? কথা নেই বার্তা নেই ডেকে পাঠানো। একটা কাজে এসেছ তো নাকি? এবারে গিয়ে একটু বোলো। তুমি নরম বলে ওরা সব চেপে বসে তোমার উপর, যেন আর কেউ নেই।‘
আমি দাঁত মাজতে মাজতে ভাবলাম বিদিশা কি জানবে সত্যিটা কি। আমি যেটা বললাম তাতে ওর রিয়াকশন এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু যদি আমি মিতার কথা বলি তাহলে জানি ওর কি হতে পারে।
বিদিশা বাকিদের মানে চিত্ত আর নিকিতাকে ডেকে তুলল। আমার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। কেউ আর কোন কথা না বলে তৈরি হয়ে নিল। নাস্তা জানি আমার মুখে ঢুকবে না, তবু ওরা যাতে না খেয়ে থাকে তার জন্য আমাকেও খেতে হবে। নাস্তা নিয়ে এলাম। ওরা খেল সাথে আমিও। খাবার এতো যে বেস্বাদ লাগে এই প্রথম বুঝলাম। কোনরকমে খেয়ে ফেললাম। ওদেরকে যে বুঝতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই।
নিচের থেকে ফোন এলো যে টিকিট হয়ে গেছে। ভগবান আছেন জানতে পারলাম। একটু যেন সুখের ছোঁওয়া পেলাম মনের মধ্যে।
সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। এয়ারপোর্টে চলে এলাম হোটেলের গাড়ীতে। বোর্ডিং পাশ নিতে নিতে মনে মনে বললাম, ‘মিতা আরেকটু আপেক্ষা করো। আমি আসছি।‘
সিকিউরিটি চেক করার সময় নিকিতা জিজ্ঞেস করলো, ‘গৌতম ব্যাপারটা সত্যি অফিসের তো? তোমার মুখ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না।‘
বিদিশা কথাটা শুনে বলল, ‘মনে মনে আমিও তাই ভাবছিলাম। জিজ্ঞেস করবো ঠিক করছিলাম।‘
আমি সামনের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম, ‘আমি জানি না তোমরা এইভাবে কেন জিজ্ঞেস করছো? অফিসের ব্যাপারই।‘ নিজেকে রোধ করলাম আর কিছু বলার থেকে কারন আমার গলা ভেঙ্গে আসছিলো।
আমার কপালই এমন আমার দুটো ভালো বন্ধুকে আমি জানাতে পারছি না আমার কি হয়েছে। জীবনের সুখ যে ওদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার অধিকার আমার নেই।
প্লেনে বসে আমার চোখের সামনে মিতার মুখ ভাসতে লাগলো। মিতা হাসপাতালে বালিশের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। সেদিনের মত ওর চোখের দু কোল দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে। ঠাণ্ডা প্লেনে আমার এতো গরম লাগছে কেন? পকেট থেকে রুমাল বার করে কপাল মুছলাম। আর সবার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম। কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে না। বাঁচা গেছে। দেখলেই জিজ্ঞেস করতো এই গরমে আমি ঘামছি কেন।
প্লেন টেক অফ করলো। অন্যান্য সময় আমার এই সময়টা একটু ভয় করে। আজ শুধু মিতার মুখ ছাড়া অন্য কিছু অনুভব হল না। প্রায় পৌনে দু ঘণ্টা পর প্লেন ল্যান্ড করলো। আমরা আস্তে করে বেড়িয়ে এলাম। এয়ারপোর্টের বাইরে বেড়িয়ে বিদিশাকে বললাম, ‘বিদিশা তোমাদের সাথে আজ যেতে পারলাম না। তোমরা একা যেতে পারবে তো?’
বিদিশা বলল, ‘আরে কি বলছ? নিজের জায়গায় এসে বাড়ি যেতে পারবো না? তুমি এগোও। যে কাজই থাকুক ভালো হোক এটাই কামনা করি।‘
আমি আর কিছু না বলে হাত নাড়িয়ে চলে এলাম অন্য দিকে। ট্যাক্সি ধরে এগোতে লাগলাম। কিন্তু যাবোটা কোথায়? কোন হাসপাতালে রেখেছে তাই তো জানি না। দিদিকে ফোন করলাম। একবার রিং বাজতেই দিদি তুলল।
দিদি জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় তুমি গৌতম?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি কোলকাতায়। যাবো কোন হাসপাতালে?’
দিদি জানালো হাসপাতালের নাম। তার মানে ভুল দিকে যাচ্ছিলাম। ড্রাইভারকে বলতে ও একবার আমার দিকে তাকিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। আবার ভুল। দিদিকে জিজ্ঞেস করাই হল না যে মিতা কেমন আছে।
দিদিকে আবার ফোন করলাম। হতাশ হলাম দিদির ফোন অন্য কলে ব্যস্ত। ছিঃ, কেন তখন জিজ্ঞেস করলাম না।
কিছু পরে প্রায় আধা ঘণ্টা হাসপাতালের সামনে এসে পৌছুলাম। ভাড়া মিটিয়ে দৌড়ে ঢুকে গেলাম ভিতরে। কোথায় আছে কোথায় আছে করতে করতে দেখলাম দিদিকে। প্রানে যেন জান এলো। দিদি আমাকে দেখতে পায় নি। দিদির হাত ধরে বললাম, ‘দিদি আমি এসে গেছি। কোথায় মিতা?’
দিদি আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি এসে গেছ গৌতম। ডাক্তার এখন মিতাকে চেক করছে। চল যাই।‘
আমি আর দিদি দোতালাতে উঠে এলাম। কেবিনের বাইরে থেকে দেখতে পেলাম একটা ভিড় মিতার বিছানা ঘিরে রয়েছে। সবার পরনে সাদা আপ্রন। মনে হয় সবাই ডাক্তার। দিদিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতো ভিড় কেন?’ মিতার পাগুলো আমার চোখের সামনে। বাকি ভিড়ে ঢাকা।
দিদি বলল, ‘এখন কিছু জানি না গৌতম। এইবার জানতে পারবো। কাল রাতে প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা হয়েছিল মিতার। কিভাবে রাত কাটিয়েছি বলতে পারবো না। ঠাকুরকে ডাকছিলাম কোনরকমে সকালটা আসুক।‘
দাদাকে দেখলাম মানে মিতার জামাইবাবুকে। ছুটে গেলাম দাদার কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা আপনি বলতে পারবেন মিতার কি হয়েছে?’
দাদা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ধৈর্য ধর। ডাক্তার দেখছে। আর কিছুক্ষণ পরে জানতে পারবে।‘
আস্তে আস্তে সবাই আসতে শুরু করেছে। মিতার ভাইয়েরা, ওদের বউরা, মিতার মেজ বোন, মেজো জামাইবাবু। আমাদের আত্মীয়র অনেক ভিড় হয়ে গেল। ডাক্তাররা দেখে বেড়িয়ে গেল। দিদি আমাকে ঠ্যালা দিয়ে একজন ডাক্তার দেখিয়ে বলল, ‘ইনি সবচেয়ে বড় ডাক্তার। এনাকে জিজ্ঞেস করো।‘
আমি কাছে গিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করে বললাম, ‘ডাক্তারবাবু আমি পেশেন্টের স্বামী। বলবেন কি কি হয়েছে আমার স্ত্রীর?’
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন, বললেন, ‘আপনি তো বাইরে ছিলেন। ভালো হয়েছে এসে গেছেন। আসুন আমার চেম্বারে আসুন।‘
আমি বললাম, ‘আসছি ডাক্তারবাবু, একবার মিতাকে মানে আমার স্ত্রীকে দেখে আসি।‘
ডাক্তার মাথা নাড়িয়ে আবার সবার সাথে আলোচনা করতে করতে হাঁটতে লাগলেন সামনের দিকে। আমি ভিতরে ঢুকলাম, মিতার পাশে দাঁড়ালাম। ইসস, একরাতে মিতার চেহারা কি হয়ে গেছে। ও আসলে যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে একা থাকলে। আমি ছাড়া ওর কাছে অন্য কেউ থাকলেও ও নিজেকে খুব একা ফিল করে। ওর তো চেহারা এরকম হবেই।
আমি মিতার মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ‘মিতা আমি এসে গেছি।‘
(চলবে)
0 Comments