মিতা খুব কষ্ট করে চোখ খুলে আমার দিকে তাকালো, একটু হাসার চেষ্টা করলো। আমার হাতের উপর হাত রেখে বলল, ‘তুমি এসে গেছ গৌতম। ভালো করেছ। এবার আমি ঠিক হয়ে যাবো।‘
আমি মিতাকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললাম। বললাম, ‘এরকম বলছ কেন? তোমার কিছু হয় নি আমি জানি।‘
ও কাঁপা হাতে আমার চোখ মুছিয়ে বলল, ‘নাগো গৌতম এবারটা মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি হয়েছে। এতো মাথা যন্ত্রণা আমার আগে হয় নি।‘
মিতার মাইগ্রেন আছে। সিজিন চেঞ্জ হলেই মাথা যন্ত্রণা হয়। আবার ঠিক হয়ে যায়। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘না না এটা তো তোমার আগের মত। দেখবে ঠিক হয়ে যাবে। আমি থাকলে কিছুতেই হাসপাতালে আনতাম না। আমি জানি যে আমার হাত পরলেই তোমার ঠিক হয়ে যায়।‘
মিতা আমার হাতটা চেপে ধরল। চোখ খুলে হাসার চেষ্টা করলো। তারপর বলল, ‘ডাক্তারের ওষুধে ব্যথাটা একটু কমেছিল। আবার যেন মনে হচ্ছে বাড়ছে। তুমি ট্যুর থেকে ফিরলে না? দ্যাখো কি কষ্ট দিলাম তোমায়।‘
মনে হচ্ছে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠি। কিন্তু সবার সামনে করতে যে পারি না। মিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘তুমি একটু একা থাক। ডাক্তার কি দেখল জেনে আসি।‘
বেড়িয়ে যেতে যেতে মিতা বলল, ‘ডাক্তার সকালে আমার মাথা স্ক্যান করেছে। কিন্তু আমাকে কিছু বলে নি।‘
আমি ওখান থেকে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমাকে ডেকেছে। আমাকে বলবে বোধহয়। আমি আসছি।‘
আমি বেড়িয়ে গেলাম। মিতার বড় আর মেজো জামাইবাবু আমার সাথে বেড়িয়ে এলো। আমরা ডাক্তারের কাছে গেলাম। কেবিনে যেতেই ডাক্তার আমাদের দেখে ডেকে নিল ভিতরে। বসতে বলল। আমি কাঁপা পায়ে একটা চেয়ারে বসলাম। আমার পাশে বড় ভায়রা তার পাশে মেজো।
ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, ‘আজ সকালে আপনার স্ত্রীকে ভর্তি করে ভালই হয়েছে। সকাল সকাল স্ক্যানটা করে নিতে পারা গেছে।‘
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মিতার অসুবিধেটা কি ডাক্তার? একটু খুলে বলবেন আমাদের?’
ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্ক্যান রিপোর্ট দেখে আমি এখুনি কোন মতামত জানাবো না। তবে মিতার কেসটা কমপ্লিকেটেড। আমার সিনিওরের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছি। ওখান থেকে এলেই বলতে পারবো মিতার কি হয়েছে।‘
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘কিন্তু কোন অনুমান? আপনারা তো ডাক্তার, বুঝতে তো কিছু পারেন।‘
ডাক্তার কিছু একটা লিখতে লিখতে বললেন, ‘হ্যাঁ তা ঠিকই। তবে এই কেসে না বলাই ভালো।‘
ডাক্তার যত কথা বলছেন তত আমার উদ্বেগ বাড়ছে। কেন তিনি বলছেন না? তিনি জানেন না এটা হতেই পারে না। উনি কেন বললেন এই কেসে কিছু না বলাই ভালো। আমি কি করবো ঠাকুর?
বড় ভায়রা পাশ থেকে বললেন, ‘গৌতম রিপোর্ট আসতে দাও। ততক্ষণ আমরা ওয়েট করি।‘
আমি দাদার দিকে তাকালাম। ওয়েট করা, কতক্ষণ? মিতাকে কি বলব? নিজেকে কি জবাব দেব? আমার গলা ভীষণ শুকিয়ে গেছে। ডাক্তারের টেবিলের উপর রাখা জলের বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে অনেকটা জল খেয়ে নিলাম। মেজদা বারন করতে গেছিলেন, ডাক্তার হাত তুলে না করলেন দেখলাম।
জল খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ডাক্তারকে, ‘রিপোর্ট কখন আসবে ডাক্তারবাবু?’
উনি উত্তর দিলেন, ‘এসে যাবার তো কথা। এই দ্যাখো তো নিচে। আউট সেকশনে রিপোর্টটা এসেছে কিনা?’
একটা লোক রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার তিন মিনিট বাদে অন্য একজন ঢুকে ডাক্তারের হাতে একটা বড় ফোল্ডার দিল। ডাক্তার ওটা দেখে বলে উঠলেন, ‘এই তো রিপোর্টটা। যাক এসে গেছে। গৌতম বাবু আপনারা এক্বটু বাইরে অপেক্ষা করুন। আপনাদের ডেকে পাঠাচ্ছি।‘
আমরা উঠে বাইরে চলে এলাম। বড়দাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, ডাক্তারটা কেমন? জানেন আপনি?’
বড়দা বললেন, ‘যা শুনেছি কোলকাতার একজন নামকরা সার্জন।‘
আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘সার্জন? উনি কি করবেন? মিতার তো মাথা ব্যথা।‘
বড়দা উত্তর দিলেন, ‘কে জানে উনিই তো দেখছেন। দেখাই যাক না।‘
আমি মনে মনে আওরাতে লাগলাম। কি আশ্চর্য, মাথা ব্যথার জন্য সার্জন? কি যে হচ্ছে?
প্রায় দশ মিনিট বাদে ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। আমরা আবার ঢুকে বসলাম চেয়ারে। ডাক্তার গলা সাফ করে বললেন, ‘হ্যাঁ আমি যা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই ঠিক গৌতম বাবু।‘
আমি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি সন্দেহ করেছিলেন?’
ডাক্তার রিপোর্ট পড়তে পড়তে বললেন, ‘মিতা মানে আপনার স্ত্রীর ব্রেন টিউমার। আর এটা হঠাৎ নয়। আমার মনে হয় ছোটবেলা থেকে মিতার ছিল। এটা এখন বড় হয়েছে।‘
আমার চোয়াল ঝুলে গেল। ব্রেন টিউমার? ডাক্তার বলেন কি? আমি দাদার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘দাদা আমি যা শুনলাম আপনারা তাই শুনলেন?’
দাদা আমার কাঁধে হাত রেখে চাপ দিল। আমি আবার ডাক্তারকে বললাম, ‘কিন্তু ডাক্তার আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে মনে হয়। মিতার মাইগ্রেন আছে। ওর টিউমার থাকবে কি করে?’
ডাক্তার আমার হাতে হাত রেখে বললেন, ‘গৌতম বাবু মাইগ্রেন একটা রোগের নাম। মাইগ্রেন আর টিউমার এক নয়।‘
আমি নাছোড়বান্দার মত বললাম, ‘কিন্তু ওর যে মাঝে মাঝে মাথা ব্যাথা হত, একটু হাত বুলালেই সেরে যেত।‘
ডাক্তার বললেন, ‘আপনাদের মনে হত সেরে যেত। কিন্তু ওটা থেকে যেত। আর সেটাই এখন বড় আকার নিয়েছে।‘
বড়দা আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে এখন কি হবে ডাক্তার বাবু?’
ডাক্তার চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘অপারেশন ছাড়া কোন পথ নেই।‘
আমরা তিনজনে বলে উঠলাম, ‘অপারেশন?’
ডাক্তার বললেন, ‘হ্যাঁ। তবে জানি না ঠিক হবে কিনা। টিউমার অপারেশনে কোনদিন ঠিক হয় না। সাময়িক রিলিফ হতে পারে। আর এই অপারেশন লিডস টু মোর কমপ্লিকেশি। নাও ইউ ডিসাইড কি করবেন আপনারা?’
বড়দা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সাজেস্ট করেন ডাক্তার বাবু?’
ডাক্তার বললেন, ‘আমি অপারেশন সাজেস্ট করবো। যদি ঠিক হয়ে যায়।‘
আমার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো, ‘আর যদি না ঠিক হয়…’ বাকিটা বলতে পারলাম না। কেঁদে ফেললাম ডাক্তারের সামনে।
মেজদা আমাকে তাড়াতাড়ি উঠিয়ে বাইরে নিয়ে এলেন। বলতে লাগলেন, ‘গৌতম তোমাকে শক্ত হতে হবে। তুমি ভেঙ্গে পরলে মিতাকে কে সামলাবে? তুমি স্টেডি হও।‘
আমাকে টেনে নিয়ে এলো নিচে ফাঁকা জায়গায়। আমি উপরে চোখ তুলে দেখলাম। নীল আকাশটা কেমন কালচে রঙের দেখাচ্ছে। রোদ যেন শীতল আগুন। আমার চারপাশে সবাই ভিড় করছে। ওরা সব আলোচনা করছে। এতো ভিড়ে আমি একদম একা। কেউ নেই যেন আমার কাছে। মিতার কথা মনে আসছে।
বিয়ের পর কোন একসময় মিতা বলেছিল, ‘জানো গৌতম, আমার কি ইচ্ছে?’
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে জড়িয়ে ধরে, ‘কি ইচ্ছে বোলো দেখি।‘
মিতা আমার গালে হাত দিয়ে বলেছিল, ‘আমার ইচ্ছে আমার যেন খুব বড় কোন রোগ হয়। তাহলে তুমি আমার পাশে থেকে সারাদিন সেবা করবে আমার। আমি কি ভাগ্যবান স্ত্রী হব বলতো। ভাগ্যবান স্ত্রীই স্বামীর সেবা পায়।‘
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম। কিছু বলি নি।
মিতা কষ্টে আছে। মিতার কি হবে আমি জানি না। আমার সারা গা হাতপা কাঁপছে। আমি ধীরে ধীরে ঘাসের উপর বসে পরলাম। কে যেন আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে। আমি উপরের দিকে তাকিয়ে ভগবানকে বললাম, ‘ঠাকুর, জীবনের সুখের পিছনে তুমি এই দুঃখ লুকিয়ে রেখেছিলে? আমাকে একবারও জানতে দাও নি। এখন আমি কি করবো? তুমি বলে দেবে?’
আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। এই রঙ্গিন পৃথিবী আমার চোখে কেমন ঝাপসা হয়ে উঠলো। কাছের জিনিস সব একে একে হারিয়ে যেতে লাগলো ওই ঝাপসা দৃষ্টির সামনে।
(সমাপ্ত)
0 Comments