অপি যেদিন সেঞ্চুরি করল, রীমা আপু সেদিন চেঁচাতে চেঁচাতে গলা ভেঙে ফেলেছিল। রাস্তায় নেমে পাড়ার দাঁড়িওয়ালা বদমেজাজী চাচাদের সাদা পাঞ্জাবি রঙিন করে দিয়েছিল ওড়না কোমরে পেঁচিয়ে নির্লজ্জ্বের মত দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে। অন্য কোন দিন হলে তাকে "বেয়াদব" টাইপের দুয়েকটা গালি হজম করতে হত। কিন্তু সেদিন কারো কিছু বলার মত সাহস হয়নি। আপুই পাড়ার সব মেয়েদের নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। বুড়ো ভামেদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশের প্রথম সেঞ্চুরি সবাই মিলে রঙে ঢঙে উৎযাপন করা হয়েছিল। অবশ্য সেকথা আমার আবছাভাবেও মনে পড়েনা। কিন্তু রীমা আপু কোমর বেঁধে রাস্তায় নেমে বুড়োদের গায়ে রঙ ছিটাচ্ছে, একথা অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠেনা। বড় চাচার অঢেল সম্পত্তি, একটামাত্র আদরের কন্যা। ব্রিলিয়ান্ট এই চাচাত বোনটি দেশের প্রথম সারির ভার্সিটি থেকে পাশ করেও ক্যারিয়ার গড়তে পারেনি। মেয়ে মানুষের চাকরি বাকরি করার দরকার নেই, সেই বেদবাক্য অনুসরণ করে বড় চাকুরে পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের পরও আপু বেশিরভাগ সময় বাপের বাড়িতে কাটায়। দুলাভাই ভাল মানুষ। তবে শ্বাশুড়ীর সঙ্গে স্বাধীনচেতা বৌয়ের বনিবনা হয়না। দুলাভাই আসলেই ভাল মানুষ, বৌ বাপের বাড়ি থাকলেও তার কোন আপত্তি নেই। উনি বড় বিজ্ঞানি টাইপ কিছু একটা। দিনরাত রিসার্চ নিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে শ্বশুরবাড়ি আসেন। আপুর বাচ্চাকাচ্চা নেই, বাসায়ই বসে থাকে। আমাদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটায়। তবে সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে যে কাজটা করে, তা হল রাত জেগে ক্লাব ফুটবলের ম্যাচগুলো দেখা আর দিনের বেলায় আমাদের সঙ্গে বার্সা-রিয়াল নিয়ে টীন এজারদের মত তর্ক করা। বয়স ত্রিশের বেশি হয়েছে, কিন্তু চঞ্চলতা এখনো কমেনি। খেলা নিয়ে তর্ক করার সময় এখনো কোমর বেঁধে গলা চড়িয়ে তোলে। ফুটবল বোদ্ধা দুই চাচাত ভাই বাদে আমরা সবাই এ ব্যাপারে তার সঙ্গে ভয়ে ভয়ে কথা বলি। তর্ক করার লোকেরও অভাব নেই। আমাদেরটি সহ তিন চাচার বাড়ি পাশাপাশি। আপুর বানানো কেক, পুডিং, ফাস্ট ফুডের লোভে প্রতিদিনই দুয়েকজন তার সঙ্গে গল্প করে আসে।
ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ক্রিকেটের আগ্রহে ভাটা পড়েনি। দেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর বসেছে। আপু যথারীতি এক্সাইটেড। দুলাভাই আমাদের সবার জন্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকিটের ব্যবস্থা করলেন। সবাই মহা খুশি। উনার মত লোক ছুটি নিয়েছেন সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উপভোগ করার জন্য! ভাবা যায়? কেউ কাউকে কিছু না বললেও আমরা জানি, উনি আপুকে ইমপ্রেস করার জন্যেই এত আয়োজন করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে যাবার প্রস্তুতি নিয়েছেন। আপু কিন্তু এতে খুশি না হয়ে বরং বেজার হল। গান বাজনা নাচানাচি দেখতে যাবার ইচ্ছে তার নেই, বরং বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ বরের সঙ্গে বসে দেখতে চায়। কিন্তু দুলাভাইয়ের কিছুতেই সময় হবেনা। আপু শেষ পর্যন্ত রাগ করে আমাদের সঙ্গে গেলইনা। অনুষ্ঠান খারাপ হয়নি। একগাদা শালা শালীদের নিয়ে দুলাভাইও বেশ মজা করলেন। উনি মজা করতে পারেন, সে ধারণা ছিলনা। মমতাজের মরার কোকিলে শুনে গোঁফ ছড়িয়ে কেমন হো হো করে হাসছিলেন, দেখে আমারও হাসি পেয়েছিল। আমরা এদিকে দাপাদাপি করলেও আপু ওদিকে ঘরে বসে ফুঁসছিল।
পরদিন গিয়ে দেখি আপু গোমড়া মুখে সোফায় পদ্মাসন করে বসে আছে। গতকাল কি কি হল তা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। কিন্তু সে ওসব শুনতে চাইল না। কিছুক্ষণ অস্বস্তি নিয়ে বসে থেকে উঠে চলে যাচ্ছি, আপু ডাক দিল।
- ঐ, শোন!
- বল, আপু।
ওদিকে তাকিয়ে বললাম।
- কালকের খেলার টিকেট যোগার করতে পারবি?
একটু ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করল।
- করা যাবে।
ঠোঁট বাঁকিয়ে বললাম। টিকেট তো পাওয়া যাবে, কিন্তু দাম আকাশ ছোঁয়া। প্রথম ম্যাচ, বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার।
- দুইটা টিকেট কিনবি, বুঝছস?
- দুলাভাই ছুটি পাইছে? তোমরা দুইজন যদি যাও, উনিই তো টিকেটের ব্যবস্থা করতে পারে।
- না, ওর ছুটি নাই। তুই দুইটা টিকিট যোগার কর, আমার সাথে যাবি। কোন সমস্যা?
একগুঁয়ে কন্ঠে আদেশ দিয়ে তীব্র চাহনি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
- না, সমস্যা নাই।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম। মাঠে হৈ হৈ করার চেয়ে ঘরে বসে গা এলিয়ে খেলা দেখতেই বেশি ভাল লাগে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গেলে অন্য কথা, মেজাজী মেয়েমানুষ সঙ্গে নিয়ে হৈ হৈ ও করা যাবেনা খুব একটা। ভ্যাপসা বিকেল আর পানসে সন্ধ্যার জন্য প্রস্তত হয়ে গেলাম।
- আর শোন, বাংলাদেশের জার্সি আছে তোর কাছে?
- না।
- আচ্ছা। থাকলেও লাভ নাই। পুরান টা দিয়া হবেনা। নতুন জার্সিটা সুন্দর হইছেনা?
চটপট কথা বলছে আপু।
- হু, ভাল হইছে।
- আজকে দুইটা জার্সিও কিনে আনবি। আর শোন, হুদা গেঞ্জি দিয়ে হবেনা, সঙ্গে ট্রাউজার।
0 Comments