এই ভয়ই করছিলাম। খেলাধুলার ব্যাপারে একদম আঁটঘাট বেঁধে নামা চাই। এখন টিকেট আর জার্সির জন্যে দুই দিকে যেতে হবে।
- এই ধর!
বলে নাটকীয় ভঙ্গিতে হাতের মুঠোয় রাখা টাকা বসা অবস্থায়ই আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। বেশ অবাক হলাম, আপু কাউকে টাকা পয়সা দেয়না। আমাদের দিয়ে এটা ওটা আনায়, কিন্তু কখনোই টাকা দেয়না। সেটা এক টাকার জিনিস হোক, আর এক হাজারের হোক। আমরা তার ঘর থেকে এটা ওটা দামী জিনিস সরিয়ে, সুস্বাদু কেক টেক খেয় সে পয়সা উসুল করি। আজ আমাকে অগ্রীম টাকা দিচ্ছে বলে বুদ্ধিদীপ্ত মুখে একটু বিব্রতির ছাপ। টাকা মুঠোয় নিয়ে হাতটিও এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিল।
- কই যাস!
আমি ঘুরে হাঁটা ধরতে চেঁচিয়ে উঠল আপু।
- কি হইল আবার?
- তোর চুলের এই অবস্থা ক্যান? বান্দরের মত মাথা খাজ্জাইতেছিস! যা, আগে সেলুনে গিয়া বস। ছোট করে চুল কাটবি, নাহইলে চুল টাইনা ছিঁড়মু।
ঠিক নেই, আসলেই চুল ধরে টানাটানি করতে পারে। ছোটবেলায় আমাদের সবাইকে উনার কাছে পড়তে হয়েছে। নানা রকম সৃজনশীল উপায়ে শাস্তি দিত, এখনো ভয় ভয় লাগে।
আরেকবার গাঁইগুঁই করলাম, টিকিটগুলো দুলাভাইয়ের বন্ধুর মাধ্যমে নিলে সহজ হবে। আপুর রুদ্রমূর্তি দেখে চুপ করে গেলাম।
বিকেলে জার্সি কিনতে গিয়ে বিপদে পড়লাম, সাইজ টাইজ কিছুই তো জানা হয়নি। মোবাইল বের করে কানে দিলাম। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছি কি জিজ্ঞেস করব। কি জিজ্ঞেস করব, "আপু, তোমার বুক কত?" নাহ! হয়তো স্রেফ টি শার্টৈর সাইজ জিজ্ঞেস করলেই হবে.. M X XL... ফোন ধরলনা কেউ। চারবার চেষ্টা করে আপুকে না পেয়ে একদম বড় সাইজেরটা নিয়েই চলে এলাম।
সকাল সকাল টিকিট হাতে পেলাম, দাম দিতে হয়েছে পাঁচ গুণ। গোসল সেরে টিকিট আর জার্সি নিয়ে আপুর ওখানে চলে এলাম। আপু যখন জার্সি পড়ে ড্রইং রুমে এল, ভাবলাম সাইজ ছোট হয়ে গেছে। বুকের নিচে, বগলের আশেপাশে কুঁচকে থাকা কাপড় টেনে ঠিক করছে যত্নসহকারে।
- ছোট হইছে নাকি, আপু?
ভয়ে ভয়ে বললাম।
- ক্যান? নাহ!
চওড়া হাসি দিয়ে আমাকে আস্বস্ত করল। টানটান সবুজ জার্সির ওপর দিয়ে গোলকের মত বুকদুটো কেমন উঁচু হয়ে আছে। রীমা আপু বেশ লম্বা চওড়া। সব সময় সালোয়ার কামিজ পড়ে থাকে বলে সবকিছু অত ভালভাবে চোখে পড়েনি।
- কি দেখিস?
- নাহ! কিছুনা!
ঝট করে চোখ নামিয়ে বলি।
- চল, দেরি হয়ে যাবে।
আপু আমার আগে আগে সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ল। আমি ধীরে সুস্থে নেমে দেখি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে চোখে বিরক্তি নিয়ে আমার আগমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে।
- কিরে, এতক্ষণ লাগে?
- বাইরে কি কর, গাড়ি কই?
- নাই, আম্মা নিয়া গেছে।
- তো, ক্যামনে যাইবা?
- ক্যামনে আবার! তুই কি দিয়া যাস?
- লোকাল বাসে..
মুখ গোমড়া করে বললাম বিড়বিড় করে।
আজীবন ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়া আপুর কাছে লোকাল বাস কেমন লাগবে জানিনা, তবে আমার ধারণা ছিল গাড়িতে বসে আরাম করে গা এলিয়ে দিতে পারব।
রিক্সা নিয়ে চলে এলাম মহাসড়কে। লোকাল বাসে না উঠে লেগুনায় উঠলাম। বাসের গাদাগাদি আপুর কেমন লাগবে ঠিক নেই। আজ এই রাস্তার গাড়িগুলোতে যাত্রী শুধু মিরপুরের। কিশোর তরুণদের চোখেমুখে উত্তেজনা। লেগুনায় মেয়েদের একটা গ্রুপ খিলখিল করে হাসাহাসি করছে। আপু জানালার পাশের সিটে বসেছে। বেড়িবাঁধের ওপাশ পানিতে পরিপূর্ণ, যতদূর চোখ যায়। তীব্র বাতাসের ধারায় লম্বা খোলা চুল উড়ছে, আমার মুখে আছড়ে পড়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ব্যাপারটা উপভোগ করার চেষ্টা করছি, কিন্ত গালে সুড়সুড়ি লাগায় বারবার চুল সরিয়ে দিতে হচ্ছে। আপু একমনে নীল আকাশ আর ভাসমান কচুরিপানা দেখছিল, কন্ডাক্টরের গলা শুনে এদিকে তাকিয়ে আমার অবস্থা দেখে হেসে ফেলল। তারপর কিছু না বলে চুলগুলো মুচড়ে ডান কাঁধের সামনে নিয়ে নিল। এখন আর সুড়সুড়ি লাগছেনা, কিন্তু মনে হচ্ছে কি যেন ছিল - কি যেন নেই।
0 Comments