বজ্রাঘাত পর্ব ১৬ (collected)



ড্রইংরুমে ছবিটা হাতে নিয়ে চুপ করে সেটার দিকে তাকিয়ে বসেছিল পৃথা। প্রণববাবু বাথরুমে গিয়েছেন কিছুক্ষন আগে, তাই ওই সময়টায় ছবিটাকে হাতে তুলে নিয়েছিল সে। ‘অর্নব, যাক, তোমার নামটা তাহলে এতদিনে জানতে পারলাম’ মনে মনে বলে পৃথা, ‘তুমি যে বিবাহিত, সেটা তো বুঝেইছি, ওটা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না আগেও... কিন্তু নামটা জানার খুব ইচ্ছা ছিল... শুধু নাম নয়... আমি আরো জানতে চাই তোমার সম্বন্ধে... আরো... সব কিছু... জানি এটা একেবারেই আমার ছেলেমানুষি... আমার এই কৌতুহল তুমি জানতে পারলে নিশ্চয়ই হাসবে... রাগ করবে কি? কেন? রাগ করার কি আছে? আমার তোমার ব্যাপারে জানার ইচ্ছা হতেই পারে... কি? পারে না?... লিন্ডা... মানে তোমার বউ রাগ করবে তাতে? দূর... সেই বা জানছে কি করে? তাই না?... সত্যিই অর্নব... কি অদ্ভুত না? হয়তো তুমি কতওও দূরে কোথায় নিজের বউয়ের কাছে বসে রয়েছে... শুধু বসেই বা রয়েছ বলি কি করে? হয়তো এই মুহুর্তে আদর খাচ্ছ বউয়ের কোলে মাথা রেখে... আর তোমারই ফ্ল্যাটে বসে তোমার কথা চিন্তা করছে একেবারে অপরিচিত একটা মেয়ে... তুমি জানতেও পারছ না... থাকনা... নাই বা জানলে আমার কথা... আমিই শুধু না হয় জেনে রাখি তোমায়... কি মনে হচ্ছে তোমার? ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়? সে তো আগেই স্বীকার করে নিয়েছি... যেদিন প্রথম এই ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখি তোমাকে, ছবিতে... সেদিনই যে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম... সেটা তুমি পাগলামী বলো আর যাই বলো... এটা শুধুই আমার... শুধু আমার অনুভূতি... তুমি জানতেও পারবে না... অস্বীকার করবো না... একটু যে লিন্ডাকে হিংসা হয় না তা নয়... একটু কেন... বেশ হিংসা হচ্ছে... ইশ... ও কি লাকি বলো তো... তোমাকে সব সময় কাছে পায়... আর আমি শুধু তোমায় ছবিটাতেই দেখি... কোন দিনও পাব না তোমায়... না?’ ভাবতে ভাবতে কেমন যেন সিরসির করে শরীরটা... আবার সেই অদ্ভুত অনুভূতি... তার মনে হয়, কেউ যেন তার পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে... তাকেই দেখে যাচ্ছে এক মনে... বারে বারে কেন যে এই ধরণের অনুভূতিটা তার হয় কে জানে... নিশ্চয়ই মনেরই ভূল।

গলার খ্যাকারিতে চটকা ভাঙে পৃথার... কখন প্রণববাবু বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন কে জানে... লজ্জা পেয়ে যায় ও... গালের ওপরে লালিমার রেশ লাগে... হাতের ছবিটাকে তাড়াতাড়ি করে সেন্টার টেবিলের ওপরে রেখে দিয়ে প্রণববাবুর দিকে মুখ তুলে হাসে... সে হাসিতে যেন কোন বাচ্ছা মেয়ে লুকিয়ে কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার হাসি।

প্রত্যুত্তরে ভদ্রলোক মুচকি হেসে নিজের বসার জায়গায় ফিরে গিয়ে বসে পড়েন... ‘দেখছিলেন ছবিটা?’ প্রশ্ন করেন পৃথাকে।

‘হ্যা, মানে ওই আর কি...’ বলতে বলতে চোখ নামিয়ে নেয় পৃথা... লজ্জা করে এ ভাবে ধরা পড়ে যাওয়াতে।

হাতে লেগে থাকা জলটা রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বলেন প্রণববাবু, ‘যেটা বলছিলাম তখন... তা সেই বন্ধুটি চুটিয়ে প্রেম করছে... আর আমরা মানে ওর সমস্ত বন্ধুরা ওকে উৎসাহ দিয়ে চলেছি... যত রকম ভাবে তাকে সাহায্য করা যায় সেটা করতে কারুর কোন বিরাম ছিল না... বেশ কাটছিল আমাদের... বাধ সাধল মেয়েটির দাদা... একদিন এসে বেধড়ক মেরে গেল ছেলেটিকে... সে বেচারা আমাদের কাছে এসে কাঁদো কাঁদো মুখে হাজির... প্রেমিকার দাদার হাতে মার খেয়ে ফিরেছে... আমরা তো শুনে খেঁপে উঠলাম... যতই হোক, এ যেন আমাদের সকলের একটা প্রেস্টিজ ফাইট... দল বেঁধে চললাম মেয়েটির দাদাকে শাসাতে... টগবগ করে ফুটছে তখন আমাদের রক্ত... কি সাহস... আমরা থাকতে কি না আমাদের বন্ধুর গায়ে হাত?’

‘খুব বন্ধু বৎসল ছিলেন আপনারা... না?’ হেসে প্রশ্ন করে পৃথা।

‘হ্যা, তা বলতে পারেন... তখন বন্ধুই ধ্যান জ্ঞান... সব কিছু... বোঝেনই তো... কিই বা বয়স তখন...’ হাসতে হাসতে উত্তর দেন ভদ্রলোক।

‘তারপর?’ তাড়া দেয় পৃথা।

‘তারপর আমরা সবাই মিলে গিয়ে দেখা করলাম মেয়েটির দাদার সাথে... কিন্তু সামনে দেখে তো আমাদের সবার অবস্থা খারাপ... এ যে দেখি একেবারে বেয়ামবীর... এই চেহারা... যেমনি বুকের ছাতি... তেমনি হাতের গুলি... তখন কে গিয়ে কথা বলবে সেটাই ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না আমরা... প্রত্যেকেরই তখন উৎসাহে ভাঁটা পড়ে গিয়েছে... কেন এলাম সেটাই ভাবছি তখন... ঠিক সেই সময় অর্নব এগিয়ে গেলো লোকটির দিকে... কোমরে হাত রেখে লোকটির চোখে চোখ রেখে তর্ক করতে লাগল বন্ধুর হয়ে... এক কথা দু কথা বলতে বলতে শুরু হয়ে গেলো হাতাহাতি... অর্নবও কম যায় না... দুম করে দিল এক ঘুঁসি লোকটার নাকের ওপরে... গলগল করে রক্ত বেরুতে শুরু করে দিল... হটাৎ করে লোকটা একটা লাঠি নিয়ে চালিয়ে দিল... সেটা গিয়ে সোজা লাগল অর্নবের কপালে... আর একটু হলেই হয়তো ওর চোখটাতেই আঘাতটা লাগতো, কপাল গুনে সেটা হয় নি... কিন্তু বেশ ভালো মত কেটে গিয়েছিল... কিন্তু অর্নবকে কে থামায় তখন... সেই লাঠি নিয়েই বেধড়ক পেটাতে লাগল ওই রকম একটা বেয়াম করা লোককে... শেষে হার স্বীকার করতে বাধ্য করল... দুজনেরই তখন রক্তাক্ত অবস্থা... জামা কাপড় ছিড়ে রক্তারক্তি...’

‘সেই কাটা দাগটা বোধহয় এখনও রয়েছে কপালে...?’ খাটো গলায় প্রশ্ন করে পৃথা, ছবিটার দিকে তাকিয়ে।

‘হ্যা, ঠিক ধরেছেন... ভুরুর ওপরে ওই দাগটা থেকেই গেলো ওর...’ উত্তর দেন ভদ্রলোক।

‘খুব সেক্সি... দাগটা...’ গলাটাকে আরো খাদে নামিয়ে বলে ওঠে পৃথা।

‘অ্যা? কিছু বললেন?’ প্রশ্ন করে প্রণববাবু।

‘নাঃ... কিছু না... তারপর বলুন...’ মাথা নেড়ে বলে পৃথা।

‘পড়াশোনায় খুব ব্রিলিয়েন্ট ছাত্র ছিল অর্নব, জানেন... জয়েন্টএ ভালো র‍্যাঙ্ক করে আই আই টি কানপূরে কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ চান্স পেয়ে গিয়েছিল। ওখানেও খুব ভালো রেসাল্ট করেছিল... প্লেসমেন্ট পেলো ডাও’তে... কানাডায়।’ বলতে থাকেন প্রণববাবু। ‘কানাডায় চাকরিতেও খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করে ফেলেছিল... প্রায় বছর পাঁচেকের মধ্যেই চলে গেল সানফ্রান্‌সিস্কোতে... একেবারে কম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট কাম চিফ্‌ ইন্টিগ্রেটিং অফিসার হয়ে... দু হাতে কামাতে থাকলো... সেই সাথে বিশাল সন্মান।’ বলে একটু থামলেন ভদ্রলোক। পৃথাও কিছু না বলে চুপ করে রইলো।

‘এত পয়সা, এত সন্মান... কিন্তু বদলালো না অর্নব একটুও... নিয়ম করে আমাদের সবার সাথে যোগাযোগ রেখে যেত ওখান থেকে... প্রত্যেকের সাথে। এর মধ্যে বাবা মারা গেলেন ওর... আর তার কিছু দিন পর মা’ও। ইন্ডিয়াতে ফিরে সমস্ত সম্পত্তি বেচে দেবে ঠিক করল। অনেক করে বোঝালাম ওকে... ও’র বক্তব্য, কি হবে এখানে এত কিছু রেখে? ফিরবে তো না আর এখানে... ওর ইচ্ছা ছিল বিদেশেই সেটেল্ড করে যাবার... কিন্তু তবুও শেষে দুম করে আমাকে ধরে বসল... বলল, প্রণব, তোকেই দেখতে হবে আমার সব কিছু। আমার তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা... আরে... আমি বোঝাতে গেলাম যাতে ও না বিক্রি করে, কিন্তু তাই বলে আমাকে ফাঁসাবে, সেটা তো ভাবি নি... কিন্তু ও বললো, দেখ, তুই যদি না আমার এই প্রপার্টি দেখভাল করিস, তাহলে আমি বেচে দিয়ে চলে যাবো... এবার তোর সিদ্ধান্ত... আমি তা’ও অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ভবি ভোলার নয়... শেষে আমাকে ওর সমস্ত প্রপার্টির এক্সিকিউটর করে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি বানিয়ে দিয়ে ফিরে গেল বিদেশে।’

‘সেই থেকেই সামলাচ্ছেন আপনি?’ মৃদু কন্ঠে বলে পৃথা।

‘সেই রকমই বলতে পারেন।’ বলে ভদ্রলোক।

‘ওহ্‌, এই তাহলে আপনার বন্ধুর গল্প...’ বলে পৃথা... মনে মনে যেন একটু হতাশই হয় সে... হয়তো আরো কিছু আশা করেছিল সে।

টেবিলের ওপরে থাকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন প্রণববাবু, ‘সেটা হলে তো ভালোই হত মিস মুখার্জি...’

‘মানে? সেটা নয়? আরো...’ বলতে যায় পৃথা।

পৃথার প্রায় মুখের কথা থেকেই বলে ওঠেন প্রণববাবু, ‘হ্যা, আরো... এবারে ফিরে গিয়ে আরো বেশি করে কাজে ডুবে গেল অর্নব। শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। ওকে দেখার মত কেউ নেই। এমনিতেই দেখতে রাজপুত্রের মত ছিল, এই কদিন ওখানকার জল হাওয়ায় যেন আরো রূপবান হয়ে উঠল... কোন এক পার্টিতে আলাপ হল ওর সাথে লিন্ডার, লিন্ডা হেল্মস্ট্যাগ, সুইডেনএর মেয়ে...’

লিন্ডার নামটা শুনে একটু নড়ে চড়ে বসে পৃথা... চোখটা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে তার।

‘অপরূপ সুন্দরী...’ ফের বলতে থাকেন প্রণববাবু, ‘সেটা হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছেন ছবিতে দেখে... সামনে দেখলে সত্যিই চোখ ফেরানো মুস্কিল... ভগবান সম্ভবত অনেক সময় নিয়ে মেয়েটিকে গড়েছিলেন...’

একটু নড়ে বসে পৃথা... চোখ চলে যায় ছবির পানে... আড় চোখে একবার দেখে নেয় ছবির লিন্ডাকে... সত্যি... কথাটা অস্বীকার করা যায় না... কিন্তু... কিন্তু সেই বা কম কিসে? সেও তো সুন্দরী... সবাই তো তাই বলে? প্রণববাবুর কি তাই মনে হয় না? তার সামনে এই ভাবে অন্য একটা মেয়েকে সুন্দরী বলাটা ঠিক হজম করতে পারে না পৃথা... কিন্তু মুখটাকে যথা সম্ভব অভিব্যক্তিহীন করে রাখার চেষ্টা করে... বুঝতে দেয়না তার মনের মধ্যে গড়ে উঠতে থাকা মেয়েলী হিংসার রেশটুকু... আনমনে কপাল থেকে ঝুলে আসা চুলের গোছা নিয়ে পাকায় আঙুলের ফাঁকে...

‘অর্নবও তাই হয়তো প্রথম দেখাতেই চোখ ফেরাতে পারেনি... আর তাছাড়া সেও তো রূপবান... ওদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি... সময় লাগে নি একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হতে... তারপর থেকে প্রায় ওদের দেখা গিয়েছে সমস্ত জায়গায়... একে অপরের সাথে ঘুরে বেড়াতে... বেশ চলছিল ওদের প্রেমপর্ব... আমাকে অর্নব মাঝে মধ্যেই জানাতো ওদের কথা... ভালো লাগতো শুনে... ভাবতাম যাক, অর্নবটার একটা হিল্লে তো হলো। এরমধ্যে আমিও বিয়ে করলাম... ওকে খবর পাঠালাম আসার জন্য... কিন্তু ও আসতে পারলো না... অবস্য আসা যে ওর পক্ষে সম্ভব হবে না সেটা আমিও জানতাম... কারণ ও যা ব্যস্ত মানুষ, আর যা গুরু দ্বায়ীত্ব ওর ওপরে, সেখানে হটাৎ করে ইন্ডিয়ায় আসা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই কিছু মনেও করিনি। আমার বিয়ের পরে পরেই ও জানালো যে ও’ও লিন্ডাকে বিয়ে করতে চলেছে... করেও ফেলল তার পরই... ওই যে ছবিটা... ওটা ও আমাকেই পাঠিয়েছিল অ্যারাকানসাস থেকে... ওদের হানিমুনে গিয়ে...’

সিগারেটএর প্যাকেটটা হাতে তুলে এগিয়ে ধরে প্রণববাবুর দিকে... ভদ্রলোক প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট টেনে নিয়ে বলেন, ‘থ্যাঙ্কস্‌’, বলে ধরিয়ে টান দেন সিগারেটএ। পৃথাও একটা সিগারেট বের করে জ্বালায় ঠোটের ফাঁকে রেখে... ধোঁয়া ছেড়ে বলে, ‘তারপর...’

‘বছর গড়িয়ে যায়... ভিষন সুখি দুটো মানুষ... একে অপরকে ছেড়ে থাকার কথা চিন্তাও করতে পারে না... যেন মেড ফর ইচ আদার... সব চলছিল ঠিকঠাক... কিন্তু ভগবানের বোধহয় অন্য কিছু ভাবা ছিল... সহ্য হলো না ওদের এত প্রেম... হটাৎ করে ধরা পড়লো লিন্ডার শরীরের মধ্যে বাসা বেঁধেছে মারণ রোগ... হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা... সাধারণ ভাষায় যাকে বলে লিভার ক্যান্সার... যখন ধরা পড়লো... আর কিছু করার নেই... একেবারে লাস্ট স্টেজ... ধরা পড়ার পর আর মাস দুয়েক বেঁচে ছিল বোধহয় লিন্ডা... পাগলের মত চেষ্টা করেছিল অর্নব ওকে বাঁচাতে... কিন্তু পারলো না।’

শুনে স্তব্দ হয়ে যায় পৃথা... এটা সে কোন মতেই আশা করেনি... এই কিছুক্ষন আগেই মেয়েটিকে হিংসার চোখে দেখছিল ও... কিন্তু এটা শোনার জন্য কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিল না... জলে ভরে আসে তার চোখদুটি... ধরা গলায় বলে, ‘কি বলছেন মিঃ কর্মকার? লিন্ডা মারা গিয়েছে?’

‘হ্যা মিস মুখার্জি... অর্নবদের দাম্পত্য জীবনের মেয়াদ ঠিক এক বছরের ছিল...’ মৃধু কন্ঠে বলেন প্রণববাবু।

ছি ছি... কত কিই না ভাবছিল সে... মনে মনে নিজের প্রতিই বিরক্ত হয় এই ভাবে না জেনে অন্য কারুর সম্বন্ধে কিছু ভেবে নেওয়ার জন্য... লজ্জিত হয় নিজের এই অভব্যতায়... মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকে।

‘দুম করে চাকরীটা ছেড়ে দিল অর্নব তারপরই, জানেন... ছেড়ে দিয়ে সোজা চলে এলো ইন্ডিয়ায়... আমার সাথে যোগাযোগ করল... কি সান্তনা দেবো বলুন তো এই রকম একটা ঘটনার পর? অর্নব যেন একেবারে বদলে গেল... আগের সেই সদা চঞ্চল ছেলেটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেল... বেশ কিছুদিন বসে রইল নিজের বাড়িতে, নিজেকেই বন্দি করে... অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না... বুঝতে পারছিলাম, ও কিছুতেই মন থেকে এই ভাবে লিন্ডার মৃত্যুটা মেনে নিয়ে পারছে না... আর সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রায় বছর খানেক চুপচাপ বসে রইল বাড়িতে... আমি কত করে বললাম, ফিরে যখন এসেছিস, তখন না হয় তুইই তোর ব্যবসা পত্তর দেখাশুনা কর... তাতে ব্যবসারও ভালো হবে, আর মনটাও একটু ব্যস্ত থাকাতে ভালো থাকবে... কিন্তু রাজি করাতে পারিনি কিছুতেই।

সময়... সময় মানুষকে অনেক সাহায্য করে, জানেন মিস মুখার্জি... ধীরে ধীরে একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে লাগল অর্নব... প্রথম দিকের সেই পাগল পাগল মনোভাবটাও একটু একটু করে কেটে যেতে লাগলো... আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম... নিজের পৈত্রিক ব্যবসাটা তখনও না দেখা শোনা করা শুরু করলেও, নিজেকে আর অতটা বন্দি করে রাখতো না... তবে মাঝে মধ্যেই নিরুদ্দেশ হয়ে যেত... বেরিয়ে পড়তো ব্যাগ গুছিয়ে... ঘুরে বেড়াতো নানা জায়গায়... হটাৎ হটাৎ করে চলে যেত যেদিকে মন যায় সেদিকে মাস দু-মাসের জন্য... আসলে সত্যি বলতে কি, টাকার তো কোনদিনও অভাব ছিল না, তাই সেদিকটায় ভাবতে হয়নি ওকে কখনও। ইচ্ছা হলেই বেড়িয়ে পড়তো... আবার বেশ কিছুদিন পর ফিরে আসতো। প্রথম প্রথম চিন্তা করলেও, পরে আর ওর এই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করতাম না... ওকে ওর মতই থাকতে দিতাম... আমিই তখনও দেখাশোনা করে যেতাম ওর সমস্ত কিছু।’

কেন জানে না পৃথা, ওর ও অর্নবের এই পরিবর্তন শুনে ভালো লাগে... যেন একটু নিশ্চিন্ত হয় সে মনে মনে... ম্লান হেসে বলে, ‘যাক, তাহলে অর্নববাবু নিজেকে শেষের দিকে সামলে নিতে পেরেছিল যা’হোক...’ নিজের মনের মধ্যে তৈরী হওয়া খানিক আগের গ্লানিটার কিছুটা যেন প্রশমিত হয় প্রণববাবুর এই তথ্যে।

‘হ্যা, মোটামুটি সামলে নিতে পেরেছিল বলা যেতে পারে... আগের মত সবসময় হাসি ঠাট্টার মধ্যে না থাকলেও, প্রথম দিকে ফিরে একেবারে যে রকম ভেঙে পড়েছিল, সেটার থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে এসেছিল অনেকটাই।’ বলে থামলেন ভদ্রলোক। তারপর একটু নিজেকে যেন গুছিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ‘হটাৎ একদিন দুম করে আমাকে বলল, প্রণব, চল, কোলকাতা যাবো... আমি তো শুনে আকাশ থেকে পড়লাম... বললাম, কোলকাতা? কেন? শুনে বলল, এ ভাবে চুপ করে বসে থাকতে ভালো লাগছে না রে, ওখানে গিয়ে একটা কিছু করবো... তুইও বৌদিদের নিয়ে চল আমার সাথে। ততদিনে আমারও বাবা মা গত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বৌ, বাচ্ছা, তাদের স্কুল, এ ভাবে হটাৎ বললে হয় নাকি? অনেক করে বোঝালাম, কিন্তু কে শোনে কার কথা... বরাবরই ও ওই রকম, একবার যখন মাথায় ঢুকেছে, তখন সেখান থেকে ওকে সরানো কার সাধ্য... শেষে সত্যিই একদিন আমরা সবাই মিলে চলে এলাম কোলকাতায়... ওখানকার ব্যবসা সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে... হাতে বেশ ভালো কিছু টাকা পেয়েছিল... তাই দিয়ে ও এখানে একটা বড় কেমিক্যাল ফ্যাক্টারি শুরু করল... নিজে থাকার জন্য এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল আর আমাদের জন্য আর একটা ফ্ল্যাট কিনে দিল। চাইলে ও একটা বাড়িই কিনে নিতে পারতো, কিন্তু সে দিকে গেলো না, বলল, না রে প্রণব, আমার মত একার লোকের জন্য এই রকম ছোট ফ্ল্যাটই ভালো। নতুন ব্যবসায় আমাকে ওর পার্টনার করে নিল... ইনভেস্টমেন্ট ওর... আমাকে শুধু সাথে থাকতে হবে। অর্নবের দূরদর্শিতায় আর অধ্যবশায় ব্যবসা দেখতে দেখতে ফুলে ফেঁপে উঠল... দেখতে দেখতে বছর তিনেক গড়িয়ে গেল... আমাদের প্রডাক্ট প্রচুর বিদেশে যেতে লাগল...’

‘তাহলে এখন উনি কোথায়?’ চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে পৃথা।

‘সেই কথাতেই আসছি এবার... ঘটনাটা খবরের কাগজেও বেরিয়েছিল তখন... হয়তো দেখেও থাকবেন... সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল, একদিন এক ক্লায়েন্ট মিট করতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল অর্নব... যাচ্ছিল বর্ধমানের দিকে... সেদিন আমারও সাথে যাবার কথা ছিল, কিন্তু সকাল থেকে আমার ছেলেটার ধূম জ্বর হওয়াতে আমি আর ওর সাথে যেতে পারিনি...’ বলে থামলেন প্রণববাবু।

উৎকন্ঠিত গলায় প্রশ্ন করে পৃথা... ‘তারপর? তারপর কি হলো প্রণববাবু?’

‘খুব বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন... আমিও ওকে যেতে বারণ করেছিলাম, কিন্তু কথা শুনলে তো... হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল... আমার সামনে দিয়েই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল... আর তারপর...’

‘তারপর...’ গলা শুকিয়ে আসে পৃথার...

‘আর তারপর আর কোন খবর নেই...’ বলে চুপ করেন ভদ্রলোক।

‘মানে? খবর নেই মানে?’ একটু যেন গলার স্বরটা জোরে শোনায় পৃথার... ‘আবার কি উনি বেড়াতে চলে গিয়েছিলেন?’

‘নাঃ... এবারে আর বেড়াতে যাবার জন্য নিরুদ্দেশ নয়... রাস্তার ধারে ওর গাড়িটা পাওয়া যায়... জ্বলে কালো হয়ে গিয়েছিল... পরে পুলিশ তদন্ত করে জেনেছিল যে আশপাশের লোক দেখেছিল যে বৃষ্টির মধ্যে হটাৎ একটা বাজ পড়ে ওই গাড়িটার ওপরে... গাড়িটা তখন ওই রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়ে ছিল সম্ভবত... কেন, তার উত্তর দেবার আর কেউ নেই... লোকজন দৌড়ে গিয়েছিল সাহায্য করার জন্য... কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ... জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে গিয়েছিল গাড়িটা...’ বলে চুপ করেন ভদ্রলোক।

গলার মধ্যেটায় কি একটা দলা পাকায় পৃথার... ঘরের মধ্যের সমস্ত কিছু যেন ঘুরছে চোখের সামনে... খুব কষ্ট করে বলে ওঠে সে, ‘আর... আর অর্নববাবু?’ কেমন যেন কান্নাটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে বুকের ভেতর থেকে তার, অনেক কষ্টে চেপে রাখে সে ভদ্রলোকের সামনে।

‘জানি না... গাড়িটা এতটাই জ্বলে গিয়েছিল যে অর্নবের বডিটাও আর পাওয়া যায় নি... একেবারে মুছে গেল বরাবরের জন্য... হারিয়ে গেল সে...’ বলে চুপ করেন প্রণববাবু।

পৃথাও থম মেরে চুপ করে বসে থাকে সোফায়... কথা সরে না তার মুখ থেকেও... এ কি করে সম্ভব... একটা গোটা জলজ্যান্ত মানুষের এই পরিণতি হতে পারে নাকি? কিছুতেই যেন মেলাতে পারে না সে... অর্নবকে নিয়ে সে কল্পনার জাল বুনেছিল ঠিকই, কিন্তু সেও জানতো যে সেটা অবাস্তব... সেটা ছিল নিছকই নিজের মত করে নিজেকে আনন্দ দেওয়ার... হয়তো সেটা ভালোবাসা নয়, সামান্য মোহো... হিংসা হয়েছিল লিন্ডার ভাগ্য দেখে এই রকম একটা মানুষকে নিজের করে পেয়েছে বলে ঠিকই... কিন্তু তাদের যে শেষে এই পরিণতি হয়েছিল সেটা সে কিছুতেই মানতে পারে না... না, না, একি করে হয়... একটা মানুষ এই ভাবে...

দরজায় বেল বাজার আওয়াজ হয়... কিন্তু কানে যায় না পৃথার... ডুবে থাকে সে আপন চিন্তায়... আবার বেল বাজতে প্রণববাবু মৃদু গলায় বলেন, ‘মিস মুখার্জি... বেল বাজছে... সম্ভবত কেউ এসেছে...’

‘এ্যা? হ্যা...’ সম্বিত ফেরে পৃথার... ধীর পায়ে উঠে যায় দরজার দিকে... তখনও যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে সে... দরজা খুলে দেখে ওর অর্ডার দেওয়া খাবার নিয়ে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার ওপারে।

ক্রমশ...

Post a Comment

0 Comments