বজ্রাঘাত পর্ব ১৪ (collected)



দরজায় বেলের আওয়াজে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় পৃথা। প্রনববাবুর আসার কথা শোনার পরই তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিল সে।

‘ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই হ্যাংওভারটা কাটছিলই না প্রায় বলতে গেলে... অবস্য সেটা আর হবে নাই বা কেন? প্রায় ওয়াইনের পুরো বোতলটাই তো এক রাতের মধ্যে সাবাড় করে দিয়েছিলাম... তার ফল তো একটু হলেও ভুগতে হবে বৈকি...’ মনে মনে ভাবতে থাকে পৃথা, আলমারী খুলে একটা হাল্কা গোলাপী রঙের কুর্তি আর ঢোলা সালোয়ার বের করে পড়ে নিতে নিতে... মনের মধ্যে এক গুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে রেডি হয়ে থাকার জন্য। সদ্য স্নান করা ভিজে ঝাঁকড়া চুলগুলো একটা ক্লিপ দিয়ে মাথার ওপরে আটকে নেয় সে। ইচ্ছা না থাকলেও একটা ওড়না নিয়ে গায়ের ওপরে ফেলে রাখে, ভালো করেই জানে ওড়না ছাড়া কুর্তির ওপর দিয়ে ব্রা পড়া থাকলেও, বুকের বোঁটাগুলো কি রকম ফুটে উঠে থাকতে পারে তার, অপরিচিত আগুন্তুকের সামনে তাই সেই ভাবে থাকাটা যে দৃষ্টিকটু, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতেও বাঁধে না কি সেটা? যতই নিজেকে দুঃসাহসিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুক সে, আদতে তো তার ভেতরে সেই চিরন্তন বাঙালী মেয়ের নমনীয় লাজলজ্জা, ভালো, মন্দ, শিক্ষা, আত্মমর্যাদা... সমস্তটাই বিরাজমান।

বেল বাজতেই দ্রুত পায়ে বেডরুমের মধ্যে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় সে, একবার ভালো করে নিজেকে দেখে নিয়ে ফিরে আসে ড্রইংরুমে, এগিয়ে যায় দরজার দিকে। আই হোলের মধ্যে চোখ রাখে পৃথা... নজরে আসে দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে। লম্বা, স্বাস্থবান... গোল মুখ, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে রোদচশমা। পরনে ধোপদূরস্ত সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী। হাতের মধ্যে রোল করা একটা কাগজ। ভদ্রলোক বলেই মনে হয় পৃথার... ঠিক তথাকথিত বাড়িওলা মার্কা দেখতে নয়। নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায় পৃথা।

দরজার খোলার আওয়াজে সচকিত হয়ে চোখ থেকে রোদচশমাটা নামিয়ে সামনের পানেই তাকিয়ে ছিলেন ভদ্রলোক সম্ভবত, তাই দরজা খুলতেই পৃথার সাথে চোখাচুখি হয় তাঁর... মৃদু হেসে দু-হাত তুলে নমস্কার করে বলে ওঠেন, ‘নমস্কার, আমি... আমিই প্রনব কর্মকার... আমার সাথে আপনার...’

ওনার কথা শেষ হবার আগেই পৃথা প্রতিনমস্কার জানিয়ে বলে ওঠে, ‘ও, হ্যা, হ্যা... নমস্কার... বুঝতে পেরেছি... আসুন, আসুন... ভিতরে আসুন...’ বলে সরে দাঁড়ায় দরজার থেকে... ভদ্রলোক পৃথার গা বাঁচিয়ে ঘরের মধ্যে পা রাখেন।

পৃথা দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে পাশের ফ্ল্যাটের দরজাটা ততক্ষনে ফাঁক হয়ে গিয়েছে... ওপাশে অলোকবাবুর কৌতুহলী মুখ। পৃথার সাথে চোখচুখি হতে গাল চোঁয়ানো হাসি ঝরে পড়ে আলোকবাবুর, ‘কেউ এলো বুঝি?’

‘হ্যাঅ্যাঅ্যা...’ অলোকবাবুর কথা নকল করে সেই ভাবেই টেনে উত্তর দেয় পৃথা এক গাল হেসে... তারপর বলে, ‘এবার বন্ধ করি দরজাটা? আপনিও আপনার দরজাটা বন্ধ করে দিন, কেমন?’

‘ওহ... হ্যা, হ্যা... নিশ্চয়, নিশ্চয়...’ তাড়াতাড়ি বলে নিজের দরজাটা বন্ধ করে দেন অলোকবাবু, পৃথাও আর দেরি না করে দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়ায়। ভদ্রলোককে তখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, ‘আরে, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন বসুন...’ বলে সোফার দিকে হাত তুলে দেখায় সে। ভদ্রলোক দরজার কাছটায় নিজের পায়ের কোলাপুরী চটিটা খুলে রাখেন, দেখেই বোঝা যায় যথেষ্ট দামী চটিটা। ভদ্রলোক ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে বসে সোফায়, ঘাড় তুলে মুখ ফিরিয়ে দেখতে থাকে ঘরটাকে ভালো করে।

‘অনেক দিন পর এলাম, জানেন... কত যে স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই ফ্ল্যাটে...’ এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে বলে ওঠেন ভদ্রলোক।

ফ্রিজ থেকে জলের বোতল বের করে একটা গ্লাসে ঢেলে নিয়ে সেন্টার টেবিলের ওপরে রেখে ভদ্রলোকের উল্টো দিকের সোফায় বসতে বসতে পৃথা বলে, ‘ও, তাই... আগে খুব আসতেন বুঝি?’

হাতে ধরা কাগজের রোলটাকে নিজের পাশে, সোফার ওপরে রেখে টেবিলের ওপর থেকে জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে খানিকটা জল ঢকঢক করে খেয়ে নেন, তারপর গ্লাসটাকে ফিরিয়ে রেখে দিয়ে ভালো করে হেলান দিয়ে বসে পৃথার দিকে সোজাসুজি তাকান ভদ্রলোক, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলেন, ‘বৃষ্টি হলেও গরমটা কমছে না একটুও, থ্যাঙ্কস, জলটার জন্য।’ তারপর যেন পৃথার কথার প্রশঙ্গ টেনে বলে, ‘হ্যা, ঠিক বুঝেছেন, অনেকবার এসেছি এই ফ্ল্যাটে... কতবার তার কোন হিসাব নেই... দিনের পর দিন, একটা সময় তো এইটাই প্রায় বলতে গেলে আমাদের ঘর বাড়ি ছিল... কখন আছি আর কখন নেই তার কোন ঠিক ছিল না... থাকলেই হল... এই রকমই ছিল ব্যাপারটা।’

ভদ্রলোকের কথার ফাঁকে ভালো করে আপদমস্তক দেখে নিচ্ছিল পৃথা। বেশ ফর্সা, আর ভালোই স্বাস্থবান, বরং বলা চলে বেশ হৃষ্টপুষ্ট আরকি, কিন্তু হাইটটা ভালো হবার ফলে খারাপ লাগে না, নয়তো একটু বেঁটে হলেই গোলগাল ফুটবলের মত লাগত। সেটা কেমন লাগতো ভাবতেই নিজের অসাবধানেই একটা হাসির ঝিলিক খেলে যায় পৃথার ঠোঁটের কোন। পরক্ষনেই ত্রস্ত হয়ে ওঠে সে, আশ্বস্ত হয়, ভদ্রলোক নিজের খেয়ালে থাকায় তার ওই মিচকি হাসিটা না দেখাতে পাওয়ায়। উঠে দাঁড়ায় সে।

‘একটু চা খাবেন তো?’ প্রশ্ন করে পৃথা, কিচেনের দিকে এগুতে উদ্যত হয়।

হাত তুলে তাকে থামায় ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি, ‘না, না, মিস মুখার্জি, এই অবেলায় আর চা করতে হবে না আপনাকে... শুধু শুধু আমার জন্য আবার কেন চা করতে যাবেন আপনি?’

‘আরে তাতে কি হয়েছে, আপনি এসেছেন কষ্ট করে, আর একটু চা করে দিতে অসুবিধা হবে আমার? আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি। আপনি একটু বসুন...’ বলে দ্রুত পা চালিয়ে কিচেনের দিকে চলে যায় সে। আগেই চায়ের সরঞ্জাম রেডি করে রেখে দিয়েছিল, গ্যাস জ্বালিয়ে চায়ের জলটা চাপিয়ে দেয়। তাক থেকে বিস্কিটের কৌটটা বের করে প্লেটে চার পাঁচটা বিস্কিট সাজায়। একটু অপেক্ষা করে চায়ের জলটা ফোটার। ভদ্রলোকের কথাগুলো ভাবতে থাকে সে ওখানে দাঁড়িয়ে। ‘আগে অনেক এসেছিলেন ভদ্রলোক, সেটাই তো বললেন... অবস্য আসতেই পারেন, সেটাই তো স্বাভাবিক, নয়কি, উনি তো সকালেই বললেন ওই অর্নব না কে... আচ্ছা... তবে কি...’

ভাবানার মধ্যেই চায়ের জল ফুটে ওঠার শোঁ শোঁ শব্দে চটকা ভাঙে... চায়ের পাতা চামচে মেপে দিয়ে নব ঘুরিয়ে বার্নারটা নিভিয়ে দেয়। কাপ, আরো একটা ডিস, আর ছাঁকনিটা জোগাড় করে স্ল্যাবের ওপরে রাখে। ট্রে’টাকে মুছে নেয় কিচেনের কাপড়টা দিয়ে।

‘আপনি শুধু শুধু চা’য়ের জন্য ব্যস্ত হলেন, মিস মুখার্জি... না হলেও চলতো...’ কানে আসে ভদ্রলোকের কথা ড্রইংরুম থেকে বলে উঠতে।

‘না, না, কোন অসুবিধা হচ্ছে না মিঃ কর্মকার, ঠিক আছে, এই তো হয়ে গেছে, এক্ষুনি আসছি...’ উত্তর দেয় পৃথা... দুটো চায়ের কাপে ঢেলে নেয় চা’টাকে, তারপর ট্রে’য়ের ওপরে চায়ের কাপ, প্লেট আর সুগার পট সাজিয়ে ফিরে আসে ড্রইংরুমে সে। সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখা ফাঁকা জলের গ্লাসটাকে একটু পাশে সরিয়ে দিয়ে ট্রে’টাকে নামিয়ে বলে, ‘আমি কিন্তু র’টি করলাম, অসুবিধা হবে না তো আপনার?’

সোফার ওপরে সোজা হয়ে উঠে বসে বলে ওঠেন ভদ্রলোক, ‘আরে, না, না, নো প্রবলেম, এই এত বেলায় আপনি চা করেছেন, এটাই তো অনেক।’

‘না, এ আর এমন কি, এই টুকু তো চা’ই করা...’ কাপের মধ্যে পট থেকে এক চামচ চিনি নিয়ে দিয়ে বলে পৃথা, ‘এক চামচই তো?’

‘হ্যা, হ্যা, এক চামচই...’

হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয় পৃথা ভদ্রলোকের দিকে, উনিও সামনের দিকে ঝুঁকে প্লেটটা ধরে নেন। পৃথা বিস্কিটটা এগিয়ে দিয়ে নিজের কাপটা ট্রে থেকে তুলে নিয়ে নিজের সোফায় পিছিয়ে এলিয়ে বসে... ও চিনি ছাড়াই পছন্দ করে চা’টা খেতে... ছোট সিপ দেয় গরম চায়ের কাপে।

ভদ্রলোকও আবার নিজে পিছিয়ে বসে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে চামচটা নেড়ে গুলতে থাকে চিনি... তাঁর মুখ দেখে পৃথার মনে হয় উনি সম্ভবত কিছু ভাবছেন, তাই কিছু না বলে ডান পায়ের ওপরে বাঁ পা’টাকে ক্রস করে রেখে চুপচাপ চা’য়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে।

‘বাঃ, চা’টা বেশ ভালো তো?’ একটা সিপ দিয়ে বলে ওঠেন ভদ্রলোক।

পৃথার বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা উনি আসলে চা’য়ের প্রশংসা করছেন না, কোন কথার বলার আছে, তাই এই ভাবেই শুরু করতে চাইছেন। কোন উত্তর দেয় না সে, পরের কথার জন্য অপেক্ষা করে চুপ করে।

‘আচ্ছা...’ গলাটাকে একটা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নেন ভদ্রলোক, ‘বলছিলাম, ইয়ে... মিস মুখার্জি... আপনি... মানে, আপনার এখানে থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?’

‘অসুবিধা? ঠিক কি ধরনের অসুবিধা বলতে চাইছেন বলুন তো?’ পালটা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে পৃথা।

‘না, মানে, এই আর কি... আপনি তো শুনেছি এই শহরে নতুন, তাই ওই আর কি, বলছিলাম যে...’ কুন্ঠিত গলায় বলেন ভদ্রলোক।

‘এ বাবা, অসুবিধা কি বলছেন... সত্যি বলতে কি আমি তো ভাবতেই পারিনি যে কোলকাতায় এসে এত সুন্দর একটা ফ্ল্যাট পেয়ে যাবো, আর সেটাও এত সহজে... বরং সে দিক দিয়ে বলতে গেলে আমি যথেষ্ট লাকি... এই রকম একটা সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট, তাও আবার এত কম রেন্টএ, এ তো যে কোন কারুর কাছেই ভিষন লোভনীয়, তাই না?’ বলতে বলতে সোজা হয়ে উঠে বসে পৃথা।

‘হ্যা, সেটা সত্যি... কোলকাতায় এত কম রেন্টএ এমন একটা ফার্নিসড ফ্ল্যাট সচরাচর পাওয়া একটু দুষ্করই বটে... আসলে...’ বলতে বলতে থেমে যায় ভদ্রলোক।

‘আসলে?’ কথাটায় টান দেয় পৃথা।

‘না, মানে ওই আর কি... আসলে এই ফ্ল্যাটটা তো সহজে কেউ ভাড়া নিতে চাইছিল না, তাই কম রেন্টএই দিতে হল।’ কথাটা শেষ করেন ভদ্রলোক।

‘আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’ এবার প্রশ্ন করে পৃথা।

‘হ্যা, হ্যা, বলুন না...’ ভদ্রলোক সশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন।

‘না, মানে, আমি আগেও শুনেছি, এখন আপনিও বলছেন যে, এই ফ্ল্যাটটা নাকি সহজে কেউ ভাড়া নিতে চাইছিল না, কিন্তু এত সুন্দর একটা ফ্ল্যাট, আমি ঠিক মেলাতে পারছি না ব্যাপারটা...’ জিজ্ঞাসা করে পৃথা।

‘হ্যা, কিছুটা আপনি ঠিকই শুনেছেন... তবে আপনাকে আমি বলতেই পারি যে, যেটা শুনেছেন সেটা নেহাৎই একটা বাজে রটনা, আসলে সেই রকম কিছু কোন ব্যাপারই নেই... লোকে শুধু শুধুই বিনা কারণে উল্টোপাল্টা কথা শুনে ভয়ে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিতে চাইতো না... নয়তো বলুন না, আপনার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে এখানে... প্রায় এতো দিন তো থাকলেন... বলুন?’

‘না, তা হচ্ছে না ঠিকই... বরং আমি তো ভিষন ভাবে আপ্লুত, এই রকম একটা ফ্ল্যাট পেয়ে... কিন্তু তবুও... লোকে কি শুধু শুধুই ভয় পেতো?’ ফের জিজ্ঞাসা করে পৃথা। ‘আর তাছাড়া আমি শুনেছি আগেও বেশ কয়একটি ফ্যামিলি এসেছিল এই ফ্ল্যাটে, তারা নাকি দিন দুয়েকের বেশি থাকতেই পারেনি? সেটাই বা কেন?’

‘আসলে, তারা ঠিক আপনার মত এত ভালো ছিল না...’ কাঁচুমাচু মুখে উত্তর দেবার চেষ্টা করেন ভদ্রলোক।

‘আমার মত ভালো ছিল না? সেটা আবার কেমন কথা?’ অদ্ভুত লাগে প্রনববাবুর উত্তরে পৃথার।

‘ওহ... না, না, আমি ঠিক সেই ভাবে কথাটা বলতে চাই নি... প্লিজ ডোন্ট টেক ইট আদার ওয়াইজ... আসলে আমি বলতে চেয়েছি যে আপনি একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ... একা থাকেন... তাই আর কি...’ কি বলবেন ঠিক বোধহয় বুঝে উঠতে পারেন না ভদ্রলোক।

‘আচ্ছা, সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমাকে একটা কথা বলুন তো, আপনি তখন ফোনে বললেন যে আপনি ওই কি যেন নাম... অর্নব না কি... তার প্রপার্টিটা দেখাশোনা করেন... তাহলে কি এই ফ্ল্যাটটাও ওনারই?’ প্রশ্ন করে পৃথা।

কথার প্রসঙ্গান্তর ঘটতে বোধহয় একটু আশ্বস্ত হন প্রণববাবু, তাড়াতাড়ি করে বলে ওঠে, ‘হ্যা, ঠিকই তো... এ সব কিছুই অর্নবের, আমার কিছুই নয়, আমি শুধু অর্নবের হয়ে দেখাশোনা করি মাত্র...।’

‘ও, তা আপনার এই মিঃ অর্নব না কে, তিনি কি করেন, তিনি কি এই শহরেই থাকেন নাকি অন্য কোন শহরে অথবা বিদেশে থাকেন?’ হাত থেকে খালি চায়ের কাপটা ট্রেতে রাখতে রাখতে প্রশ্ন রাখে পৃথা।

নিজের খালি কাপটাও এগিয়ে রেখে দেন ট্রে’র ওপরে, তারপর সোফায় হেলে বসে পকেটে হাত ঢোকান প্রণববাবু, পরক্ষনেই কি মনে করে পৃথার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘সরি, আমি একটা সিগারেট ধরাতে পারি... ইফ ইয়ু ডোন্ট মাইন্ড...’

‘হ্যা, হ্যা... নো প্রবলেম... প্লিজ... ক্যারি অন...’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে সব কাপগুলো আর আগের জলের গ্লাসটাকে ট্রে’টার মধ্যে রেখে নিয়ে এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে। সিঙ্কের মধ্যে এঁটো কাপ গুলো রেখে দিয়ে ফিরে আসে সে। আসার পথে বেডরুমে ঢুকে নিজের সিগারেটএর প্যাকেটটা আর লাইটারটা তুলে নেয়... প্রণববাবু সিগারেট ধরাচ্ছে দেখে তার নিজেরও সুবিধা হয়। সোফায় বসে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে লাইটার জ্বালায়... লাইটারটাকে সেন্টার টেবিলের ওপরে ফিরিয়ে রেখে দিয়ে হেলান দেয় সোফায়... এক রাশ ধোয়া ছাড়ে নাক মুখ দিয়ে। প্রণববাবুও সিগারেটএর ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে লক্ষ্য করতে থাকেন পৃথাকে। চোখা চুখি হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নেন। মিচকি হাসি খেলে যায় পৃথার ঠোঁটে... বুঝতে অসুবিধা হয় না তাকে এই ভাবে ওনার সামনে এত সহজ ভাবে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে দেখে একটু অপ্রস্তুতই হয়েছেন ভদ্রলোক... এখনও পুরুষেরা মেয়েদের সিগারেট ধরাতে দেখলে প্রথমে একটা ঝটকা খায়... তাই বুঝেও কিছু বলে না সে, সিগারেটএ আর একটা লম্বা টান মেরে বলে ওঠে, ‘কই, বললেন না তো... আপনার এই অর্নব না কে, সে কোথায় থাকেন? এখানেই বা থাকেন না কেন?’

‘বলছি... তবে আমার মনে হয় তার আগে আমাদের আগে কাজটা সেরে নেওয়া উচিত, আসলে যে জন্য আসা আমার, সেটা ফেলে রেখে কি লাভ, তাই না...’ বলে পাশ থেকে রোল করা কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে দেন পৃথার দিকে।

পৃথা ওনার হাত থেকে কাগজের রোলটা নিয়ে খুলে ধরে চোখের সামনে...

‘ওই যে, দেখুন, তৃতীয় পাতার নীচে আপনার সইটা বাদ পড়ে গেছে, ওটা একটু করে দেবেন কাইন্ডলি...’ পৃথাকে কাগজটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে দেখে বলে ওঠেন ভদ্রলোক।

‘আমি একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারি এটাতে?’ প্রশ্ন করে পৃথা।

‘হ্যা, হ্যা, নিশ্চয়ই... দেখে নিন না ভালো করে...’ তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন প্রণববাবু।

রেন্ট এগ্রিমেন্টই বটে... পৃথা মুখার্জি আর অর্নব বাসুর মধ্যে... সাধারণতঃ আগডুম বাগডুম যা যা এই ধরনের এগ্রিমেন্টএ থাকে, তাই রয়েছে... তবে একটা জায়গায় গিয়ে সে থমকায়... ভালো করে পড়ে মুখ তোলে ভুরু কুঁচকে... ‘আচ্ছা... এখানে তো কোন রেন্ট ডিউরেশন মেনশন করেন নি... মানে বলতে চাইছি সাধারণত আমি যা শুনেছি, এই ধরনের এগ্রিমেন্ট সামথিং এগারো মাস বা ওই ধরনের একটা টাইম পিরিয়েডের মধ্যে হয়... কিন্তু সেটা তো এখানে নেই... ব্যাপারটা কি? আমার তো মনে হচ্ছে আগে যে এগ্রিমেন্টটায় আমি সই করেছিলাম সেটাতে একটা ওই ধরনেরই টাইম পিরিয়েড মেনশেন্ড ছিল... কিন্তু এটাতে তো দেখছি সেই ক্লজটা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেন?’

‘হ্যা... মানে... না... মানে... হ্যা, ওই আরকি... আপনি ঠিকই ধরেছেন... আগে যখন এগ্রিমেন্ট করার কথা হয়েছিল তখন ওই টাইম পিরিয়ডটা মেনশন্ড করা হয়েছিল, কিন্তু পরে আর কি ওটা আর রাখি নি...’ আমতা আমতা করে উত্তর দেন ভদ্রলোক।

‘রাখেন নি, সেতো দেখতেই পাচ্ছি... কিন্তু হোয়াই? কেন?’ কাগজের ওপরে চোখ বোলাতে বোলাতে ফের প্রশ্ন করে পৃথা।

‘না, ভাবলাম, আপনি বাইরের থেকে এসেছেন, আর তাছাড়া আপনার যখন এই ফ্ল্যাটটা এত ভালো লেগে গিয়েছে, তখন থাক না ওই সব... আপনার যত দিন খুশি... যত মাস... যত বছর খুশি আপনি থাকুন না এখানে... যেদিন ভালো লাগবে না... সেদিন না হয় ছেড়ে চলে যাবেন... আমাদের কোন আপত্তি নেই তাতে...’ অ্যাস্ট্রের মধ্যে সিগারেটএর বাড্‌সটা চেপে গুঁজে দিতে দিতে কোন রকমে উত্তর দেন প্রণববাবু, পৃথার চোখের দিকে না তাকিয়ে।

‘আমাদের?’ ভুরু কুঁচকে মুখ তোলে পৃথা।

‘না, মানে, সরি, আমার... ওই আর কি...’ তাড়াতাড়ি নিজের ভুলটা সংশোধন করে ওঠেন ভদ্রলোক।

‘ভাড়া অ্যাপ্রিশিয়েষনএর ক্লজটাও তো দেখছি বাদ দিয়েছেন... কি মশাই... এই একই ভাড়ায় সারা জীবন থাকব নাকি আমি?’ এবার একটু হেসেই ফেলে পৃথা।

পৃথাকে হাসতে দেখে বোধহয় একটু মনে বল পান প্রণববাবু, তিনিও হেসে বলেন, ‘থাকুন না... আপনার তাতে কি... যদি মনে হয় বাড়াবেন, দেবেন’খন বাড়িয়ে... আপনার সুবিধা মত... আমি বলার কে?’ বলতে বলতে বুক পকেট থেকে একটা পেন বের করে খাপ খুলে, পেনটা বাড়িয়ে দেন পৃথার দিকে।

পৃথা হাতে ধরা সিগারেটএ একটা টান দিয়ে, সেটাকে অ্যাস্ট্রের ধারে রেখে হাত বাড়িয়ে প্রণববাবুর পেনটা নিয়ে নেয়... তারপর পাতা উল্টে তৃতীয় পাতায় গিয়ে সই করে, পৃথা মুখার্জি, সই এর নিচে তারিখে সেই দিনের উল্লেখ করতে ভোলে না... তারপর পেন আর কাগজের রোলটা ফিরিয়ে দেয় প্রণববাবুর হাতে, নিজে সোফায় আবার হেলান দিয়ে বসে আরাম করে, অ্যাস্ট্রের সাইড থেকে সিগারেটটা তুলে নিয়ে।

প্রণববাবু পৃথার হাত থেকে এগ্রিমেন্টটা নিয়ে ভালো করে রোল করতে থাকেন আবার, আর পৃথা উল্টো দিকের সোফায় হাতের আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটা ধরে ওনাকে দেখতে থাকে চুপচাপ।

হটাৎ কেন জানা নেই, পৃথার গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে... ঝট করে সে মাথা ঘোরায় ডাইনে, তারপর বাঁয়ে... তার মন যেন বলে ওঠে এই মুহুর্তে ঘরের মধ্যে শুধু সে আর প্রণববাবু নন, আরো একজন কোন তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত রয়েছে... কিন্তু সেটা শুধু সে অনুভব করতে পারছে মাত্র, দেখতে পাচ্ছে না। ভুরু কুঁচকে যায় তার। তবে কি...
(চলবে)

Post a Comment

0 Comments