ক্রেডিটঃ- Jyoti Bandyopadhyay
ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে এককাপ চা হাতে দৈনিক সংবাদপত্র নিয়ে বসলাম। প্রথম পাতাতেই একটা নিউজ দেখলাম। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এই বছর তার “শাহাজাদা দারাশুকো” উপন্যাসের
জন্য এ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। দারুন ভালো লাগলো খবরটা পড়ে। একবার ভাবলাম শ্যামলদাকে একটা ফোন করে বলি, দাদা এই নিউজটা আমাকে কাগজে পড়ে জানতে হলো। তারপর নিজের মধ্যে একটা অভিমান কাজ করলো। না আমি কিছুতেই শ্যামলাদেকে ফোন করবো না। দেখি শ্যামলদা নিজে থেকে ফোন করে কিনা।
যথারীতি কাগজের অফিসে এলাম। সময় মতো। টেবিলে বসতেই মল্লিকদা বললো তোকে দাদা ডাকছে।
কেনো।
আমি কি করে বলবো। কালকে আসিসনি কেনো।
ভালো লাগছিলো না।
অগত্যা উঠে দাদার ঘরে এলাম। ঢুকতেই বললো।
কখন এলি।
এই তো এখুনি।
চেয়ারে বসলাম।
হাতে কোনো কাজ আছে।
না। তুমি দিলে আছে।
একবার শ্যামলের বাড়ি যা।
কেনো!
সকাল থেকে অনেকবার ফোন করেছে। অনি এলে যেনো পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মনে মনে ভীষণ আনন্দ হলো যাক শ্যামলদা অনিকে ভোলে নি তাহলে।
তোর তো কোনো ফোন নম্বর নেই। যেখানে থাকিস পাশাপাশি কোনো ফোন নম্বর নেই।
আমি ব্যবহার করি না।
যা চলে যা। বাড়ি হয়ে একবার যাস।
আচ্ছা।
বেরিয়ে এলাম। নিউজরুমে এসে মল্লিকদাকে বলে বেরিয়ে গেলাম।
সোজা চলে এলাম গড়িয়া ব্রহ্মপুর বটতলা। ঘরে ঢুকতেই শ্যামলদা হাসলেন। তুই আসছিস তোর দাদা ফোন করে বলেদিয়েছে। দেখতো একটু খেয়ে তোর বৌদি বেতো শাকটা কেমন বানিয়েছে। নিজের প্লেট থেকে একটু তুলে দিলেন মুখে। খেলাম।
সেদিন সারাটা দিন শ্যামলদার বাড়িতে ছিলাম। অনেকে এসেছিলেন অভিন্দন জানাতে। শ্যামলদার ভাই আর এক দিকপাল সাংবাদিক তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ও এসেছিলেন।
একটু বিকেল বিকেল হতেই সকলে চলে গেল। আমরা একটুক্ষণ বসে কথা বললাম। তারপরেই শ্যামলদা বললেন চল অনি ওই ঝিলের ধারে বসে দুজনে একটু সুরা সেবন করি।
আজ না করলেই নয়।
তোর বৌদির কাছ থেকে পার্মিসন নিয়ে নিয়েছি। কাল কোলেস্টরেল চেক করেছি। এখন নর্মাল।
তাই আজ সুরাপান করে কোলেস্টরেলটা বাড়াবে।
দুর বোকা সুরাপান করলে কোলেস্টরেল বাড়ে না। বরং হার্ট বিট ঠিক থাকে। তুই তো মতিকে (মতি নন্দী) দু-বোতল কিনে দিয়ে এসেছিস।
মতিদার স্পেশ মেকার বসানো আছে। ডাক্তার প্রেসকিপসন করেছে, রেগুলার দু-পেগ করে খেতে।
আমারটাও বসিয়ে নেবো অসুবিধে হবে না।
হাসলাম।
চল চল এখুনি সব আবার এসে পরবে। তার আগে পালিয়ে যাই। তোর বৌদিকে বলবো, কেউ এলে বলে দেবে আমি বেরিয়ে গেছি।
দু-জনে পায়ে পায়ে চলে এলাম ঝিলের ধারে।
সতরঞ্চিটা নে।
বৌদির কাছ থেকে সতরঞ্চিটা নিলাম।
আনুষাঙ্গিক যা লাগে তা সঙ্গে নিয়ে নিলাম। ঝিলের ধারটা নিঝুম। আধা অন্ধকার। বেশ বুঝতে পারছি, মাছ গুলো ঝিলের জলের ওপরে এসে ভুঁট মারছে। শ্যামলদা নিজে হাতে বোতল খুলে গেলাসে ঢাললেন। নানা গল্প চলছে। হঠাৎ আমি বলে বসলাম, দাদা তুমি একবার কথায় কথায় বলেছিলে তুমি জীবনে একবার মাত্র গণিকা পল্লীতে গেছিলে, কিন্তু কেনো গেছিলে তা বলো নি।
তুই আমার লেখ ওই গল্পটা পরিসনি!
কোন গল্পটা বলোতো।
মনে খুব ব্যাথা পেলাম, আমার লেখা বিখ্যাত গল্পের মধ্যে ওটা একটা, তুই পরিস নি!
শ্যামলদা চোঁ-চো করে জল খাবার মতো করে গেলাসটা নিঃশেষ করে আবার ঢেলে নিলেন।
কিরে তোর তো একটাই শেষ হলো না। আমার দুটো হয়ে গেলো।
তুমি খাও না।
আউট হলে তুলে নিয়ে যেতে পারবি তো।
তুমি আউট হবে না, আর হলে তুলে নিয়ে যেতে পারবো।
জানিস অনি, সেবছর জোর কদমে পূজো সংখ্যার কাজ চলছে, তুষারদা (তুষারকান্তি ঘোষ, যুগান্তরের সম্পাদক) বললেন শ্যামল তোমার উপন্যাসটা কবে দেবে।
আমি তখন এক লাইনও লিখি নি। কি বলবো। এতো বড়ো একজন মান্যিগন্যি মানুষ। বললাম দাদা এবার যদি উপন্যাস লিখতে না পারি ক্ষমা করবেন।
তার মানে। বিজ্ঞাপনে তোমার নাম যাচ্ছে।
এখনো একলাইনও লিখতে পারিনি।
তাহলে!
দেখি যদি একটা গল্প লিখতে পারি।
এখনো বলছো লিখতে পারি। মাসটা কি আছে মনে আছে। আগস্ট। তাও শেষের দিকে চলছে। সেপ্টেম্বরের বাইশ তারিখ মহালয়। কবে তুমি লেখা দেবে, কবে ছাপবো, কবে হকারদের কাছে বই পৌঁছে দেবো।
মনটা খুব খারাপ হয়েগেলো বুঝলি। তুষারদার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। যতোই হোক আমাকে মাসে মাসে পয়সা দেন। সংসার চলে। কি করবো ভেবে উঠতে পারছি না। ভাবলাম কামশাস্ত্রটা পরে একটা ভালো সেক্সের ওপর লেখা লিখে দেবো।
তারপর ভাবলাম। আমার নিজের একটা পাঠক কুল আছে, তারা কি ভাববে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনস্থির করলাম। একবার গণিকা পল্লীতে গেলে কেমন হয়। লোকের কাছে গল্প শুনেছি। যাওয়া হয় নি। সমরেশকে (সমরেশ বসু, ছদ্মনাম কালকূট) একটা ফোন করলাম। ও প্রায়ই যায়, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। আমি যাবো। এ কথা সে কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দিলাম।
পরদিন গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবী, কাঁচি পার ফিনফিনে ধুতি, পায়ে মোজা পাম্প শ্যু লাগালাম। তোর বৌদি তো আমার ওই পোষাক দেখে হেসে লুটো পুটি। তুমি কোথায় যাবে! এই কালোয়ার মার্কা পোষাক পরে ?
বলতে কি পারি, তোমায় ছেড়ে আমি গণিকা পল্লীতে যাচ্ছি। দেবে মুড়ো ঝাঁটার বাড়ি।
বেরিয়ে এলাম। একটা ট্যাক্সি ধরে গ্রে স্ট্রীট। সন্ধ্যে হয়েছে। যেনো মেলা বসে গেছে। সেদিনটা আবার ছিলো রবিবার। বেশ ভিড়। আমি একটা জুঁই ফুলের মালা কিনলাম। কালোয়ার, লোহার ব্যবসায়ী বলে কথা। তার আগে একটু বাড়োদুয়ারীতে বসে বাংলা কারণ সুধা টেনে নিয়েছি। পায়ে পায়ে গলিতে ঢুকলাম। আমাকে দেখে অনেকে হাসা হাসি করছে। দেখতে শুনতে ভালো মেয়েও চোখে পরলো। দাঁড়িয়ে গেলাম। একটা বছর আঠারোর মেয়েকে মোটামুটি মনে ধরলো। সে আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলো। সেই মান্ধাতা আমলের শিঁড়ি। তিনতলায় উঠতে হাঁপিয়ে গেলাম।
ঘরে ঢুকলাম। দশ বাই দশ ঘর, তাতে একটা খাট পাতা তায় একটা স্টিলের আলমাড়ি। আমাকে খাটে বসিয়ে মেয়েটা পাখা খুলে দিলো। আমি ঘামছি। মেয়েটা কাপোর খুলে ফেললো। ব্লাউজ আর শায়া পরে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
ব্লাউজের বোতাম গুলো খুলে দাও তো।
আমি মনে মনে হাসছি।
ব্লাউজের বোতাম খুলছি।
আমার রেট কতো জানো তো।
না।
ঘন্টায় পঞ্চাশটাকা। তুমি ইচ্ছে করলে একঘন্টা দু’ঘন্টা তিনঘন্টা যত খুশি থাকতে পারো।
তখনকার দিনে পঞ্চাশ!
হ্যাঁ। তবে মেয়েটা দেখতে শুনতে বেশ ভালো।
মেয়েটা ঘরে একটু আতর ছড়িয়ে দিলো।
এবার মেয়েটা ব্রেসিয়ার আর শায়াটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে আমার পাশে বসলো।
আমি মনে মনে হাসছি। কি লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, অনেক লেখাই তো জীবনে লিখেছো। এই মেয়েটাকে তুমি জিজ্ঞাসা করো, তোমার নামও জানে না। তোমার একটা লেখাও সে পরে নি।
তুমি পাঞ্জাবীটা খোলো।
খুলছি, তাড়াহুড়ো করো না। তুমি যা চাইবে তাই দেবো খোন।
মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
ওর সঙ্গে গল্প করি একটু মস্করা করি। মাঝে মাঝেই মেয়েটা বলে তুমি কিছু করবে না।
করবো খোন, একটু রোসো না।
ওর সঙ্গে গল্প করছি।
ও আমার রকম সকম দেখে মিষ্টি আনালো। মিষ্টি খেলাম। একবারও গায়ে হাত দিই নি। ঘন্টা খানেকর ওপর গল্প করেছি বুঝলি। দেখি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কে। মেয়েটি দরজা খুললো। দেখি দুটো সন্ডামার্কা লোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, সে তো আমাকে যা নয় তাই বললো। তারপর বললো, চল থানায় চল। কচি মাল নিয়ে শোয়া বার করছি।
অগত্যা মেয়েটির হাতে তিনটে একশো টাকার নোট দিয়ে ওই সন্ডামার্কা লোক গুলোর হাতে জমা পরে গেলাম। ওরা বেশ মজা করে আমার কোমরে দড়ি পরালো। ভেবেছিলো আমি কিছু বলবো, ওরা টাকা চাইবে, দেখলো আমি কিছু বললাম না। যাক নিচে এসে প্রিজন ভ্যানে বসলাম। দেখলাম আরো চার পাঁচজন আছে। সব ওই তল্লাটের তবে আমার মতো রাইস আদমি কেউ নেই। ভ্যানেই প্রায় ঘন্টা খানেক বসে রইলাম। ওদের সঙ্গে গল্পগুজোব করলাম। সেদিন প্রথম গাঁজা খেলাম বুঝলি। আগে কখনো গাঁজাটা খাই নি। বেশ লাগলো গাঁজার বিড়ি। প্রিজন ভ্যান ভর্তি হতে গাড়ি ছাড়লো।
প্রায় ন’টার সময় বটতলা থানায় নিয়ে এলো আমাদের। প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে লম্বা করে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর নাম ধরে ধরে পেটি কেশ। আমাকে বললো আপনি লকাবে ঢুকবেন না এখান থেকে বেরিয়ে যাবেন। তারও হিসাব দিলো। কতোটাকা লাগবে। তারপর তো অকথ্য ভাষায় গালা গাল। যা হয় আর কি।
হঠাৎ একটা খাঁকি পোষাক পরা বছর পঁয়ত্রিশের ছেলে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমায় যে সাব-ইনস্পেকটরটা এতক্ষণ জিজ্ঞাসা করছিলো, সে তো স্যার বলে দাঁড়িয়ে পরে স্যালুট ফ্যালুট করতে শুরু করে দিয়েছে।
শ্যামলদা আপনি এখানে। কোনো কাজ আছে নাকি ?
সেই সাব-ইনস্পেকটর পঙ্খানুপুঙ্খ সব বললো। ছেলেটি মুচকি হেসে বললো। দাদাকে ভেতরে পাঠান। তখনও আমি ছেলেটিকে চিন্তে পারছি না।
এইবার তো সেই ইনস্পেক্টরের প্যান্ট হলুদ হবার জোগাড়। আমার হাতে পায়ে ধরে আরকি, সাহেব কি আপনার ভাই। কে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভেতরে এলাম, চা এলো, মিষ্টি এলো। খালি হুকুম করতে যতক্ষণ। আমি কিছু বাদ দিই নি। গো গ্রাসে সব খেলাম। ছেলেটিকে বললাম ভাই তোমাকে তো চিনলাম না।
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনাকে ভালো করে চিনি। আপনি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই অমৃত থেকে আপনার লেখা পরছি।
বুঝলাম পুলিশ হলেও সাহিত্যের খোঁজ খবর রাখে। যখন অমৃতের কথা বললো।
আপনি ওই নোংরা জায়গায় গেছিলেন কেনো।
ওকে আমার গর্ভযন্ত্রণার কথা কি করে বলি।
যাক একটু রাতের দিকে নিজের গাড়ি করে আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেলো। তোর বৌদি দেখলো আমি পুলিশের গাড়ি থেকে নামছি। মুখে বাংলার গন্ধ। বোঝার আর কি বাকি রইলো। দেড়ে মুশে গালাগাল। সাতদিন কথা বন্ধ। লিখে ফেললাম “একটি নষ্ট মেয়ের আত্মকাহিনী”।
লেখাটা পূজো সংখ্যায় বেরোবার পর প্রথম ফোন পেয়েছিলাম সেই পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে, আমার উপন্যাসের ও ছিলো একটা চরিত্র। নাম কি জানিস, নজরুল ইসলাম, তারপর নজরুল অবশ্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছে, ওর উপন্যাসের জন্য। আর একবার ওই মেয়েটির কাছে গেছিলাম, সেবারের পূজা সংখ্যা নিয়ে, নজরুল সঙ্গে ছিলো। সেদিন সেই মেয়েটি আমার পরিচয় পাবার পর আমাকে বাবা বলে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
গেলাসটা একনিমেষে শূন্য করে দিয়ে। শ্যামলদা আমার মুখের দিকে তাকাল।
জানিস অনি গণিকা পল্লীথেকে বেড়িয়ে আসার সময় আমার মনকে বোঝালাম, আমার মনের হদিস আমার পাশে যে কুড়ি বছর ধরে শুচ্ছে, যার শরীরটা নিয়ে আমি কতো নাড়া চাড়া করেছি, আমার দুটো সন্তান তার গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, সেইই পাই নি, তো ওই কচি মেয়াটা।
শ্যামলদার চোখ চিক চিক করে উঠলো।
September 3, 2017
(কাজলদিঘীর ছোট্ট একটি অংশ এটি।, আজও খুঁজে চলেছি এই উপন্যাস এর সম্পূর্ণ অংশ, কিন্তু পাচ্ছিনা 😞
ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে এককাপ চা হাতে দৈনিক সংবাদপত্র নিয়ে বসলাম। প্রথম পাতাতেই একটা নিউজ দেখলাম। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এই বছর তার “শাহাজাদা দারাশুকো” উপন্যাসের
জন্য এ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। দারুন ভালো লাগলো খবরটা পড়ে। একবার ভাবলাম শ্যামলদাকে একটা ফোন করে বলি, দাদা এই নিউজটা আমাকে কাগজে পড়ে জানতে হলো। তারপর নিজের মধ্যে একটা অভিমান কাজ করলো। না আমি কিছুতেই শ্যামলাদেকে ফোন করবো না। দেখি শ্যামলদা নিজে থেকে ফোন করে কিনা।
যথারীতি কাগজের অফিসে এলাম। সময় মতো। টেবিলে বসতেই মল্লিকদা বললো তোকে দাদা ডাকছে।
কেনো।
আমি কি করে বলবো। কালকে আসিসনি কেনো।
ভালো লাগছিলো না।
অগত্যা উঠে দাদার ঘরে এলাম। ঢুকতেই বললো।
কখন এলি।
এই তো এখুনি।
চেয়ারে বসলাম।
হাতে কোনো কাজ আছে।
না। তুমি দিলে আছে।
একবার শ্যামলের বাড়ি যা।
কেনো!
সকাল থেকে অনেকবার ফোন করেছে। অনি এলে যেনো পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মনে মনে ভীষণ আনন্দ হলো যাক শ্যামলদা অনিকে ভোলে নি তাহলে।
তোর তো কোনো ফোন নম্বর নেই। যেখানে থাকিস পাশাপাশি কোনো ফোন নম্বর নেই।
আমি ব্যবহার করি না।
যা চলে যা। বাড়ি হয়ে একবার যাস।
আচ্ছা।
বেরিয়ে এলাম। নিউজরুমে এসে মল্লিকদাকে বলে বেরিয়ে গেলাম।
সোজা চলে এলাম গড়িয়া ব্রহ্মপুর বটতলা। ঘরে ঢুকতেই শ্যামলদা হাসলেন। তুই আসছিস তোর দাদা ফোন করে বলেদিয়েছে। দেখতো একটু খেয়ে তোর বৌদি বেতো শাকটা কেমন বানিয়েছে। নিজের প্লেট থেকে একটু তুলে দিলেন মুখে। খেলাম।
সেদিন সারাটা দিন শ্যামলদার বাড়িতে ছিলাম। অনেকে এসেছিলেন অভিন্দন জানাতে। শ্যামলদার ভাই আর এক দিকপাল সাংবাদিক তরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ও এসেছিলেন।
একটু বিকেল বিকেল হতেই সকলে চলে গেল। আমরা একটুক্ষণ বসে কথা বললাম। তারপরেই শ্যামলদা বললেন চল অনি ওই ঝিলের ধারে বসে দুজনে একটু সুরা সেবন করি।
আজ না করলেই নয়।
তোর বৌদির কাছ থেকে পার্মিসন নিয়ে নিয়েছি। কাল কোলেস্টরেল চেক করেছি। এখন নর্মাল।
তাই আজ সুরাপান করে কোলেস্টরেলটা বাড়াবে।
দুর বোকা সুরাপান করলে কোলেস্টরেল বাড়ে না। বরং হার্ট বিট ঠিক থাকে। তুই তো মতিকে (মতি নন্দী) দু-বোতল কিনে দিয়ে এসেছিস।
মতিদার স্পেশ মেকার বসানো আছে। ডাক্তার প্রেসকিপসন করেছে, রেগুলার দু-পেগ করে খেতে।
আমারটাও বসিয়ে নেবো অসুবিধে হবে না।
হাসলাম।
চল চল এখুনি সব আবার এসে পরবে। তার আগে পালিয়ে যাই। তোর বৌদিকে বলবো, কেউ এলে বলে দেবে আমি বেরিয়ে গেছি।
দু-জনে পায়ে পায়ে চলে এলাম ঝিলের ধারে।
সতরঞ্চিটা নে।
বৌদির কাছ থেকে সতরঞ্চিটা নিলাম।
আনুষাঙ্গিক যা লাগে তা সঙ্গে নিয়ে নিলাম। ঝিলের ধারটা নিঝুম। আধা অন্ধকার। বেশ বুঝতে পারছি, মাছ গুলো ঝিলের জলের ওপরে এসে ভুঁট মারছে। শ্যামলদা নিজে হাতে বোতল খুলে গেলাসে ঢাললেন। নানা গল্প চলছে। হঠাৎ আমি বলে বসলাম, দাদা তুমি একবার কথায় কথায় বলেছিলে তুমি জীবনে একবার মাত্র গণিকা পল্লীতে গেছিলে, কিন্তু কেনো গেছিলে তা বলো নি।
তুই আমার লেখ ওই গল্পটা পরিসনি!
কোন গল্পটা বলোতো।
মনে খুব ব্যাথা পেলাম, আমার লেখা বিখ্যাত গল্পের মধ্যে ওটা একটা, তুই পরিস নি!
শ্যামলদা চোঁ-চো করে জল খাবার মতো করে গেলাসটা নিঃশেষ করে আবার ঢেলে নিলেন।
কিরে তোর তো একটাই শেষ হলো না। আমার দুটো হয়ে গেলো।
তুমি খাও না।
আউট হলে তুলে নিয়ে যেতে পারবি তো।
তুমি আউট হবে না, আর হলে তুলে নিয়ে যেতে পারবো।
জানিস অনি, সেবছর জোর কদমে পূজো সংখ্যার কাজ চলছে, তুষারদা (তুষারকান্তি ঘোষ, যুগান্তরের সম্পাদক) বললেন শ্যামল তোমার উপন্যাসটা কবে দেবে।
আমি তখন এক লাইনও লিখি নি। কি বলবো। এতো বড়ো একজন মান্যিগন্যি মানুষ। বললাম দাদা এবার যদি উপন্যাস লিখতে না পারি ক্ষমা করবেন।
তার মানে। বিজ্ঞাপনে তোমার নাম যাচ্ছে।
এখনো একলাইনও লিখতে পারিনি।
তাহলে!
দেখি যদি একটা গল্প লিখতে পারি।
এখনো বলছো লিখতে পারি। মাসটা কি আছে মনে আছে। আগস্ট। তাও শেষের দিকে চলছে। সেপ্টেম্বরের বাইশ তারিখ মহালয়। কবে তুমি লেখা দেবে, কবে ছাপবো, কবে হকারদের কাছে বই পৌঁছে দেবো।
মনটা খুব খারাপ হয়েগেলো বুঝলি। তুষারদার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। যতোই হোক আমাকে মাসে মাসে পয়সা দেন। সংসার চলে। কি করবো ভেবে উঠতে পারছি না। ভাবলাম কামশাস্ত্রটা পরে একটা ভালো সেক্সের ওপর লেখা লিখে দেবো।
তারপর ভাবলাম। আমার নিজের একটা পাঠক কুল আছে, তারা কি ভাববে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনস্থির করলাম। একবার গণিকা পল্লীতে গেলে কেমন হয়। লোকের কাছে গল্প শুনেছি। যাওয়া হয় নি। সমরেশকে (সমরেশ বসু, ছদ্মনাম কালকূট) একটা ফোন করলাম। ও প্রায়ই যায়, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। আমি যাবো। এ কথা সে কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দিলাম।
পরদিন গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবী, কাঁচি পার ফিনফিনে ধুতি, পায়ে মোজা পাম্প শ্যু লাগালাম। তোর বৌদি তো আমার ওই পোষাক দেখে হেসে লুটো পুটি। তুমি কোথায় যাবে! এই কালোয়ার মার্কা পোষাক পরে ?
বলতে কি পারি, তোমায় ছেড়ে আমি গণিকা পল্লীতে যাচ্ছি। দেবে মুড়ো ঝাঁটার বাড়ি।
বেরিয়ে এলাম। একটা ট্যাক্সি ধরে গ্রে স্ট্রীট। সন্ধ্যে হয়েছে। যেনো মেলা বসে গেছে। সেদিনটা আবার ছিলো রবিবার। বেশ ভিড়। আমি একটা জুঁই ফুলের মালা কিনলাম। কালোয়ার, লোহার ব্যবসায়ী বলে কথা। তার আগে একটু বাড়োদুয়ারীতে বসে বাংলা কারণ সুধা টেনে নিয়েছি। পায়ে পায়ে গলিতে ঢুকলাম। আমাকে দেখে অনেকে হাসা হাসি করছে। দেখতে শুনতে ভালো মেয়েও চোখে পরলো। দাঁড়িয়ে গেলাম। একটা বছর আঠারোর মেয়েকে মোটামুটি মনে ধরলো। সে আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলো। সেই মান্ধাতা আমলের শিঁড়ি। তিনতলায় উঠতে হাঁপিয়ে গেলাম।
ঘরে ঢুকলাম। দশ বাই দশ ঘর, তাতে একটা খাট পাতা তায় একটা স্টিলের আলমাড়ি। আমাকে খাটে বসিয়ে মেয়েটা পাখা খুলে দিলো। আমি ঘামছি। মেয়েটা কাপোর খুলে ফেললো। ব্লাউজ আর শায়া পরে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
ব্লাউজের বোতাম গুলো খুলে দাও তো।
আমি মনে মনে হাসছি।
ব্লাউজের বোতাম খুলছি।
আমার রেট কতো জানো তো।
না।
ঘন্টায় পঞ্চাশটাকা। তুমি ইচ্ছে করলে একঘন্টা দু’ঘন্টা তিনঘন্টা যত খুশি থাকতে পারো।
তখনকার দিনে পঞ্চাশ!
হ্যাঁ। তবে মেয়েটা দেখতে শুনতে বেশ ভালো।
মেয়েটা ঘরে একটু আতর ছড়িয়ে দিলো।
এবার মেয়েটা ব্রেসিয়ার আর শায়াটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে আমার পাশে বসলো।
আমি মনে মনে হাসছি। কি লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, অনেক লেখাই তো জীবনে লিখেছো। এই মেয়েটাকে তুমি জিজ্ঞাসা করো, তোমার নামও জানে না। তোমার একটা লেখাও সে পরে নি।
তুমি পাঞ্জাবীটা খোলো।
খুলছি, তাড়াহুড়ো করো না। তুমি যা চাইবে তাই দেবো খোন।
মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
ওর সঙ্গে গল্প করি একটু মস্করা করি। মাঝে মাঝেই মেয়েটা বলে তুমি কিছু করবে না।
করবো খোন, একটু রোসো না।
ওর সঙ্গে গল্প করছি।
ও আমার রকম সকম দেখে মিষ্টি আনালো। মিষ্টি খেলাম। একবারও গায়ে হাত দিই নি। ঘন্টা খানেকর ওপর গল্প করেছি বুঝলি। দেখি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে কে। মেয়েটি দরজা খুললো। দেখি দুটো সন্ডামার্কা লোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, সে তো আমাকে যা নয় তাই বললো। তারপর বললো, চল থানায় চল। কচি মাল নিয়ে শোয়া বার করছি।
অগত্যা মেয়েটির হাতে তিনটে একশো টাকার নোট দিয়ে ওই সন্ডামার্কা লোক গুলোর হাতে জমা পরে গেলাম। ওরা বেশ মজা করে আমার কোমরে দড়ি পরালো। ভেবেছিলো আমি কিছু বলবো, ওরা টাকা চাইবে, দেখলো আমি কিছু বললাম না। যাক নিচে এসে প্রিজন ভ্যানে বসলাম। দেখলাম আরো চার পাঁচজন আছে। সব ওই তল্লাটের তবে আমার মতো রাইস আদমি কেউ নেই। ভ্যানেই প্রায় ঘন্টা খানেক বসে রইলাম। ওদের সঙ্গে গল্পগুজোব করলাম। সেদিন প্রথম গাঁজা খেলাম বুঝলি। আগে কখনো গাঁজাটা খাই নি। বেশ লাগলো গাঁজার বিড়ি। প্রিজন ভ্যান ভর্তি হতে গাড়ি ছাড়লো।
প্রায় ন’টার সময় বটতলা থানায় নিয়ে এলো আমাদের। প্রিজন ভ্যান থেকে নামিয়ে লম্বা করে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর নাম ধরে ধরে পেটি কেশ। আমাকে বললো আপনি লকাবে ঢুকবেন না এখান থেকে বেরিয়ে যাবেন। তারও হিসাব দিলো। কতোটাকা লাগবে। তারপর তো অকথ্য ভাষায় গালা গাল। যা হয় আর কি।
হঠাৎ একটা খাঁকি পোষাক পরা বছর পঁয়ত্রিশের ছেলে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমায় যে সাব-ইনস্পেকটরটা এতক্ষণ জিজ্ঞাসা করছিলো, সে তো স্যার বলে দাঁড়িয়ে পরে স্যালুট ফ্যালুট করতে শুরু করে দিয়েছে।
শ্যামলদা আপনি এখানে। কোনো কাজ আছে নাকি ?
সেই সাব-ইনস্পেকটর পঙ্খানুপুঙ্খ সব বললো। ছেলেটি মুচকি হেসে বললো। দাদাকে ভেতরে পাঠান। তখনও আমি ছেলেটিকে চিন্তে পারছি না।
এইবার তো সেই ইনস্পেক্টরের প্যান্ট হলুদ হবার জোগাড়। আমার হাতে পায়ে ধরে আরকি, সাহেব কি আপনার ভাই। কে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভেতরে এলাম, চা এলো, মিষ্টি এলো। খালি হুকুম করতে যতক্ষণ। আমি কিছু বাদ দিই নি। গো গ্রাসে সব খেলাম। ছেলেটিকে বললাম ভাই তোমাকে তো চিনলাম না।
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনাকে ভালো করে চিনি। আপনি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই অমৃত থেকে আপনার লেখা পরছি।
বুঝলাম পুলিশ হলেও সাহিত্যের খোঁজ খবর রাখে। যখন অমৃতের কথা বললো।
আপনি ওই নোংরা জায়গায় গেছিলেন কেনো।
ওকে আমার গর্ভযন্ত্রণার কথা কি করে বলি।
যাক একটু রাতের দিকে নিজের গাড়ি করে আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেলো। তোর বৌদি দেখলো আমি পুলিশের গাড়ি থেকে নামছি। মুখে বাংলার গন্ধ। বোঝার আর কি বাকি রইলো। দেড়ে মুশে গালাগাল। সাতদিন কথা বন্ধ। লিখে ফেললাম “একটি নষ্ট মেয়ের আত্মকাহিনী”।
লেখাটা পূজো সংখ্যায় বেরোবার পর প্রথম ফোন পেয়েছিলাম সেই পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে, আমার উপন্যাসের ও ছিলো একটা চরিত্র। নাম কি জানিস, নজরুল ইসলাম, তারপর নজরুল অবশ্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছে, ওর উপন্যাসের জন্য। আর একবার ওই মেয়েটির কাছে গেছিলাম, সেবারের পূজা সংখ্যা নিয়ে, নজরুল সঙ্গে ছিলো। সেদিন সেই মেয়েটি আমার পরিচয় পাবার পর আমাকে বাবা বলে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
গেলাসটা একনিমেষে শূন্য করে দিয়ে। শ্যামলদা আমার মুখের দিকে তাকাল।
জানিস অনি গণিকা পল্লীথেকে বেড়িয়ে আসার সময় আমার মনকে বোঝালাম, আমার মনের হদিস আমার পাশে যে কুড়ি বছর ধরে শুচ্ছে, যার শরীরটা নিয়ে আমি কতো নাড়া চাড়া করেছি, আমার দুটো সন্তান তার গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, সেইই পাই নি, তো ওই কচি মেয়াটা।
শ্যামলদার চোখ চিক চিক করে উঠলো।
September 3, 2017
(কাজলদিঘীর ছোট্ট একটি অংশ এটি।, আজও খুঁজে চলেছি এই উপন্যাস এর সম্পূর্ণ অংশ, কিন্তু পাচ্ছিনা 😞
0 Comments