পুলিশ এসেছিল মায়া ভট্টাচার্যের বয়ান নিতে।তিনি কোথাও বলেন নি বাবুয়ার নাম।পুলিশ কিছুটা হতাশ শান্তিবাবুর স্ত্রীর বয়ানে।শান্তিবাবুর এই বাড়ী একসময় ছিল রাজনীতির কেন্দ্র।তার মৃত্যুতে ছিন্ন হয়ে গেছে যোগ।মায়াদেবী রাজনীতি পছন্দ কররেন না তার মেয়ে ঊষশী রাজনীতিকে ঘেন্না করে।
বাড়ীটা অঞ্চলের আর পাচটা সাধারণ বাড়ীর মত হয়ে গেল রাতারাতি। শান্তিবাবুর মৃত্যুতে বরেন বোসের উত্থান সহজ হয়ে যায়।শোক মিছিল স্মরনসভা সবেতেই প্রধান ভুমিকা বরেনবোসের থাকলেও সবাই জানে দুজনের সম্পর্ক ছিল আদা কাচ কলা।বরেন বসু সভায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সমাজ বিরোধীর ঠাই নেই দলে।কানাঘুষায় শোনা যায় মুন্না নাকি এখন আছে বরেনবসুর শেল্টারে।
কাঞ্চার ডাকডাকিতে ঘুম ভাঙ্গল এমার।কাঞ্চার হাত থেকে চা নিয়ে বলল,বোসো।
কাঞ্চা বসে বলল,তাড়াতাড়ি বলেন মেমসাব।হাতে মেলা কাজ।
কাঞ্চার এই ব্যস্তভাব এমার ভাল লাগে।মজা কোরে বলল,আচ্ছা তোমার নিজের সংসার নেই তাহলে কেন এত ব্যস্ততা?
–সংসার থাকলে এত ব্যস্ততা থাকতো না।
কাঞ্চার কথাটা বোঝার চেষ্টা করে এমা।কাঞ্চা আড়চোখে মালকিনকে দেখে ফিক কোরে হেসে বলল,নিজের জন্য করলে মনে শান্তি লাগে।
–তাহলে বিয়ে করে সংসার করনা কেন?
–বাপু বলেছে টাইম হলেই সাদি দিবে।
–বাপু কি ঘুমোচ্ছে?
–বাঙালী বাবুকে নিয়ে ক্যাণ্টিনে চা খেতে গিয়েছে।
–সোমের সঙ্গে তোমার বাপুর খুব ভাব?
–বাঙালীবাবুর কথা শুনতে বাপুর ভাল লাগে।
এমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে কাঞ্চি বলল,যাই মেমসাব?
এমা মিষ্টি হাসল।মহারাজের কথাগুলো নিয়ে ভাবে।মনের দো-টানা ভাব।এমা ভাবার চেষ্টা করে তার মনে কি সুপ্তভাবে অন্যটান আছে? ড্যাড একটা ছেলেকে এনেছিল ইচ্ছে করেই তাকে এড়িয়ে গেছে।মম পাঠিয়েছিল ছেলেটিকে।
বিডি মুখার্জি বেরবার আগে বলল,সোমবার এ্যাপয়ণ্টমেণ্ট পাওয়া গেছে।অনেকদিন ধরে তাগাদা দিচ্ছিল আখী মুখার্জি।ওখানে দুজন গাইনি আছে ড.এমা আর প্রিয়া যাদব।ড.প্রিয়া বিদেশ থেকে পাস কোরে এলেও ড.এমার চাহিদা অনেক বেশি।সংশ্লিষ্ট মহল মজা করে বলে ড.এমা ডাক্তার নয় যাদুকরী।সোম বুধ শুক্র এই তিনদিন বসে এমা।অন্যান্য নার্সিং হোম থেকে ডাক পেলে যেতে হয়।মফস্বলের প্রতি এমার একটা আলাদা আকর্ষণ আছে।
তবে শনিবার কোনো কাজ রাখে না সেদিন ঝড়জল হলেও মিশনে যাওয়া চাই।বর্মীরা ধারনত বুদ্ধের অনুগত হয়।কিন্তু দিল্লী থেকেই তার মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ।কলকাতায় এসে আরও বেড়েছে।
স্কুলে বন্দনাদির কাছে নতুন কথা শুনল।কঙ্কাকে দেখতে নাকি দিন দিন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।কঙ্কা নিজেকে আয়নায় দেখেও বুঝতে পারেনা।বন্দনাদি ডিভোর্সের ব্যাপারে প্রথম প্রথম উৎসাহ দিব্যেন্দু চলে যাবার পর মনোভাব বদলে গেছে।কিছুটা সহানুভুতির চোখে দেখে।স্বামী না থাকলে কি মেয়েরা করুণার পাত্রী?স্ত্রী নেই যে ছেলের তাকে তো লোকে এভাবে দেখেনা।সেদিন বন্দনাদির কথায় খুব খারাপ লেগেছিল যখন বলল কঙ্কা তোর যা আছে ছেলের অভাব হবে না।মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,কি আছে?
–নিজের ফ্লাট ব্যাঙ্ক ব্যালন্স কি নেই?
ফ্লাট ব্যাঙ্ক ব্যালান্সই সব তার কোনো মূল্য নেই? মুহূর্তের জন্য নিজেকে কঙ্কাবতীর খুব অসহায় বোধহয়। একজন ছিল যে সবকিছু এভাবে দেখেনা।ঋষিটা কি হালিশহর থেকে কোনোদিন ফিরবে না?
ঘরের মধ্যে ভজার দলবলকে দেখে খ্যাদানিপিসি কালুয়াকে ডেকে এনেছে।পিসির মুখে সব শুনে যেভাবে এসেছিল ঘরে ঢুকে ভজাকে দেখে কালুয়ার একেবারে অন্য চেহারা।
ভজা বলল,কালুয়া না?তুই এখানে থাকিস?
–এটা আমার মহল্লা।কালুয়া বলল।
–ভাবীজী এখানে থাকল।দেখভাল করবি।
–ভাবীজী?
–হ্যা বে গুরুর জান।ভজা বলল।
কোহিনুর ঘর গোছাচ্ছিল ঘোমটার ফাকে মুচকি হাসে ভজার কথা শুনে।
কালুয়া অবাক হয়ে বলল,বাবুভাই এখন জেলে না?
–হা-হা গুরু এখন রেস্ট নিতে গেছে।
খ্যাদানিপিসি ওদের আলাপ শুনে হতাশ হল।কালুয়া বলল,পিসি তুমি ঝুটমুট পরেশান হচ্ছো।সব আমার পহেচান লোক।পিসিকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল কালুয়া।কেতো পিছন থেকে ডেকে বলল,দুর থেকে দেখভাল করবি।এখানে আসার দরকার নেই।
কোহিনুর বলল,তোমরা একটু নেমে দাঁড়াও।
সবাই চৌকির থেকে নেমে দাড়ালো।কোহিনুর চৌকির উপর তোষোক পেতে তার উপর চাদর পেতে বলল,এবার বোসো।
–ভাবী আমরা একটু আসছি।আর কিছু আনতে হলে লিস্ট করে দাও।
–ভাল বিস্কুট আনবে।বস আসার সময় হয়ে গেছে।
–যাবো আর আসবো।
দুটো বাইক গর্জন করে চলে গেল।খ্যাদানিপিসি দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে ভাবে বেশি ঝামেলা করার দরকার নেই।শুম্ভ নিশুম্ভর দল।
কোহিনুর চৌকীতে বসে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ভাবে মোটামুটি সব হয়েছে।একটা আলমারি দরকার আয়না লাগানো।তাহলে আর ড্রেসিং টেবল লাগবে না।ঘর গোছানো হল কিন্তু আরেকটা ব্যাপার বসকে বলা দরকার।কিভাবে বলবে ভেবে পায় না।
ড.এমা ফিমেল ওয়ার্ড ভিজিটিং-এ বেরিয়ে প্রতিটি বেড ধরে খোজ খবর নিচ্ছে।এমার সঙ্গে কথা বলতে রোগীদের ভাল লাগে।বেশি কথা বলেনা কিন্তু সুন্দর হাসিটি মুখে লেগে আছে।ইংরেজি বাংলা হিন্দি যার যে ভাষা সেই ভাষাতেই কথা বলে।সঙ্গে একজন নার্স খাতা পেন্সিল নিয়ে সব লিখে নিচ্ছিল।দেখতে দেখতে একটা বেডের কাছে থমকে দাড়ালেন।
ড.এমাকে দেখ পেশেণ্ট উঠে বসল।নার্সের কাছ থেকে ব্লাড রিপোর্ট নিয়ে চোখ বোলায় এমা।দেবিকা লোধ বয়স ঊনত্রিশ।,তারপর পেশেণ্টের কব্জি ধরে নাড়ি দেখতে লাগল।
ঠোটে ঠোট চেপে কি ভাবল।পেশেণ্ট সাগ্রহে তাকিয়ে আছে।এমা বলল,আপনার স্বামী দেখতে আসে?
–হ্যা আজও এসেছিল।
–হুম উনি এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবেন।
পেশেণ্ট ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,কেন ম্যাম?
বেডের পাশে চার্ট দেখে ড.এমা বলল,মিসেস লোধ আপনার স্বামী কি করেন?
–বিজনেস।
–পেচ্ছাপের প্রবলেম কতদিন হচ্ছে?
–দিন দশেক হবে।দেবীকা বলল।
–হুউম।আপনার রোগ সেরে যাবে কিন্তু আবার হবে।
–কি হয়েছে ম্যাম?
পাশে দাঁড়ানো নার্সের দিকে একপলক দেখে ড.এমা বলল,স্যালামাইডিয়া।রোগের নাম বললে আপনি বুঝবেন না–সেক্সূয়াল ডিজিজ।আপনার স্বামীকে দেখা করতে বলবেন। দেবীকার বুক ধড়ফড় করে।সালামাডি জন্মে নাম শোনেনি।
ড.এমা নীচে নেমে এসে দেখল,গাড়ীর কাছে রোহণজীর সঙ্গে কথা বলছে সোম।তাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল,ম্যাম আমি একটু আসছি?
ড.এমার সোমকে নিয়ে মজা করতে ভাল লাগে বলল ,একজন ড্রাইভারের সঙ্গে এত কি কথা?
ঋষির কিছু বলেনা মিট্মিট করে হাসে।এমা জিজ্ঞেস করল,হাসছো কেন?
–রাগ না করলে বলতে পারি।
–কি কথা বলছিলে বললে রাগ করব কেন?
–ড্রাইভারের সঙ্গে আপনি কথা বলেন।কাঞ্চা ওর বাবার সঙ্গে কথা বলে।আমি একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলাম।রোহনজী আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছেন।ওকে ভুলবো না।
ড.এমা হেসে ফেলল বলল,আর গাড়ী পেট্রোল?
–আপনাকেও কোনোদিন ভুলবো না।ম্যাম আমি কি আসতে পারি?ঋষি অনুমতি প্রার্থনা করল।
আপনাকে ভুলবো না।এই জাতীয় কথা মানুষকে বিশেষ করে মেয়েদের খুব স্পর্শ করে।ভালই লাগে ড.এমার ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে।
দশ মিনিটের পথ ঋষি রিক্সায় না উঠে হাটতে লাগল।ভজার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে কিনা কে জানে।ঘরের যা অবস্থা কি করে কোহিনুর রাত কাটিয়েছে কে জানে।
ঋষি পৌছে বাইক-টাইকের কোনো চিহ্ন না দেখে বুঝতে পারে কোহিনুর তাহলে ওদের ঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।ভজা আসলে নিশ্চয়ই বাইক নিয়ে আসতো।অনেক কিছু ভেবে এসেছিল ভজা ছাড়া কিছুই হবে না।ঘরে ঢুকে বিস্মিত একী?চৌকিতে সুন্দর বিছানা।নিপাট পরিস্কার ঘরদোর।কিভাবে সম্ভব হল?
–বসুন বস।
তাকিয়ে দেখল কোহিনুর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে।ঋষি জিজ্ঞেস করল,এসব কে করল?
–ভজারা সব কিনে এনেছে।
–আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেল?
–আপনি বসুন।ওরা এখনই আসবে।
ঋষি বিরক্ত হয়ে চৌকিতে বসল।কোহিনুর ঘরে কোনে স্টোভ জ্বালিয়ে চা করতে থাকে।
ঋষি দেখছে নতুন স্টোভ নতুন কাপ।এইসব করতে এখানে আসা?বাইকের শব্দ পাওয়া গেল।মনে হচ্ছে ওরা এল?
পরমুহূর্তে হুড়মুড় করে সবাই ঢুকে পড়ল।চৌকিতে বসে ভজা বলল,সব শুনেছো বস?এই শালা উকিলটা এমন ক্যালানে বস একে বদলাতে হবে।
–সব শুনেছি।দু-সপ্তা পরে ডেট।সময় আছে।এখন যা বলছি শোনো।
কোহিনুর সবাইকে চা বিস্কুট দিয়ে একটা টুল নিয়ে বসল।
ঋষি বলল,জমানো টাকা এভাবে খরচ করলে কদিন চলবে?
কেতো বলল,বস আমরা ফালতু কিছু কিনিনি।তুমি দেখো চৌকি–।
কেতোকে থামিয়ে দিয়ে ঋষি বলল,আমি তা বলিনি।কি বলছি শোনো।মাখনবাবুকে চেনো?
সকলে পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।ঋষি বলল,ঐ যে ফ্লাট করা নিয়ে দোকানদারদের সঙ্গে গোলমাল হল—।
ভজা বলল,যে খুব ফটফট করছিল?ওষুধের দোকান?
–মাখনবাবুর সঙ্গে কথা হয়েছিল আগে।ওকে আমার কথা বলবে।একজন ওষুধের দোকানের অভিজ্ঞ সেলম্যান উনি দেবেন বলেছিলেন।সেই লোক নিয়ে আমার কাছে আসবে।আমি তার সঙ্গে কথা বলবো।
সফি বলল,বস এখনই যাবো?
–শোনো সফি আমাদের এখন খুব সমঝে চলতে হবে।বাবুয়া নেই এক ঝামেলা আবার তোমরা কেউ ঝামেলায় জড়ালে কোনদিক সামলাবো বলো?
সফি বলল,না আমি রিকোয়েস্ট করার কথা বলেছি।
–বস যদি লোক দেয় কোথায় আনবো,এখানে?ভজা জিজ্ঞেস করল।
–এখানে নয়।খিনকিল নার্সিং হোমে আমার খোজ করবে ওখানে থাকবো।
সবার চোখে বিস্ময়।ঋষি হেসে বলল,ওখানে কাজ করছি।
সন্তু বলল,ঐখানে ঐ মালটা আছে না?শান্তিদার চামচা?
ভজা বিরক্ত হয়ে বলল,বস কি বলল? আমাদের সমঝে চলতে হবে?দেবেশ এখন বরেন বোসের সঙ্গে লাইন করছে।
–তোমাদের কি বলছি বুঝতে পারছো না।কে কার চামচা তাতে আমাদের কি?আমাদের কারো সঙ্গে শ্ত্রূতা নেই।
–কি বলছো বস?মুন্নাকে ছেড়ে দেবো?কেতো বলল।
ঋষি চুপ করে বসে থাকে।ভজা বলল,তোরা কোনো কথা বলবি না।বস ওর কথায় কিছু মাইণ্ড কোরো না।তুমি আমাদের বস তুমি যদি মাইণ্ড করো আমাদের কি হবে বলতো?
–ঠিক আছে আর গ্যাস দিতে হবে না, সবাই হো-হো করে হেসে উঠল।কোহিনুর স্বস্তি বোধ করে।
ঋষি বলল,ঠিক আছে ভজা যা বললাম?আমাকে যেতে হবে।তোমরা যাবে না?
সন্তু বলল,আজ আমাদের পিকনিক।
ঋষি উঠতে কোহিনুর সঙ্গে সঙ্গে দরজা পর্যন্ত গেল।ঋষি জিজ্ঞেস করল,কিছু বলবেন?
কোহিনুর কিছুক্ষন ভেবে বলল,পরে বলবো।
রাস্তায় নেমে হন হন করে হাটতে লাগল ঋষি।দীর্ঘদিনের অভ্যাস রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয়।তবে তাকে ওরা খুব সম্মান করে।কোহিনুর কি যেন বলতে চায়।লজ্জা বা সঙ্কোচে বলতে পারছে না।ওষুধের দোকানে কি ওর আপত্তি?সেটা জেনে নেওয়া দরকার,অনিচ্ছুক মনকে দিয়ে কিছু করানো যায়না।অনেক ভেবে ওষুধের দোকানের কথা স্থির করেছে।কথা বলে দেখা যাক।ভজারা কোনো পরামর্শ দিল নাতো?
ড.এমা ঘরে ফিরে এসে ভাবতে থাকে কাঞ্চা বলছিল বাপু বাঙালীবাবুর কথা শুনতে ভালবাসে।মনে পড়ল মহারাজও এই রকম বলেছিল।ভিতর ছেড়ে বাইরের পরিচয়কে বড় করে দেখি।সোম ছেলেটা রিয়ালি ইন্টারেস্টিং।কেমন ক্যাজুয়ালি একটা গভীর কথা বলে গেল।
(চলবে)
0 Comments