আমি জিভ কাটলাম, ভুল হয়ে গেছে বলাটা। আমরা এখন টিফিন করছি বলে এখনো সকাল দেখছি। যাহোক ম্যানেজ করে বললাম, ‘আরে সকালকে তো সকালই বলব। যাহোক এতো দেরি হোল কেন তুলতে ফোন?’
মিতার তূরন্ত জবাব, ‘তোমার মতো তো আর ফ্রি নই যে কোলের কাছে ফোন নিয়ে ঘুরবো। তুমি ফোন করবে আর ঝট করে ফোন তুলবো। বাগানে ছিলাম, মাটি কোপাচ্ছিলাম। গাছগুলোর গোঁড়া একদম টাইট হয়ে গেছে। একটু লুস না করলে গাছ বাড়বে না। তাই দেরি হোল।‘
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘নাস্তা চা হয়ে গেছে?’
মিতা উত্তর দিলো, ‘ওমা সেই কোন সকালে। রান্নাও প্রায় শেষ হতে এলো। আজ আবার বৃহস্পতিবার। ঠাকুরের পুজো আছে। তাড়াতাড়ি করতে হবে না। তা তুমি এখন কোথায়?’
আবার মিথ্যে বলতে হোল। বললাম, ‘আমি এখন আনগুল যাচ্ছি। কাল ওখানে একটা কাজের সন্ধান নিয়ে পরশু ফিরব।‘
মিতা বলল, ‘যাক একদিন আগেই ফিরছ। শোন না, একটা কাজ করো, ওখান থেকে যদি সময় থাকে তাহলে একবার পুরী ঘুরে এসো। একটু হোটেলের খোঁজখবর নিয়ো। ভাবছি একবার পুরী ঘুরে আসবো।‘
তারমানে ট্যুরের প্রোগ্রাম হতে শুরু করেছে। এবার তাহলে পুরী। কিন্তু এই মুহূর্তে পুরী ব্যাপারটা ওর মাথায় এলো কেন। কি সাংঘাতিক এদের শক্তি। পাপ করছি আমি আর অনুভব করছে ও।
আমি বললাম, ‘দেখি সময় যদি পাই।‘
মিতা জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি গাড়িতে যাবে আনগুল?’
আমি বললাম, ‘তাছাড়া?’
মিতা জবাব দিলো, ‘না ড্রাইভারকে একটু সাবধানে চালাতে বোলো। তুমি তো আবার গাড়িতে উথলেই ঘুমিয়ে পড়। ওটা করো না। ড্রাইভারের সাথে সবসময় কথা বলবে। ও তাহলে সাবধানে চালাবে। কেমন?’
আমি বললাম, ‘ওকে দেবী, জো আজ্ঞা।‘
মিতা বলল, ‘না ইয়ার্কি না কিন্তু। একটাই তো স্বামী, সেটা হারাই কেন। তবু তো পাশে শুলে মনে হয় কেউ বিপদের সময় আছে, হাত বাড়ালে ছোঁওয়া যায়। না থাকলে তো জগৎ শুন্য হয়ে থাকতে হবে। যা বললাম মনে রেখো। এখন রাখি। পৌঁছে ফোন করো।‘
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। তুমিও সাবধানে থেকো। তুমিও আমার একমাত্র বউ।‘
মিতা উত্তর দিলো, ‘আরে আমার কথা চিন্তা করো না। আমার এখানে অনেকে আছে যারা আমাকে দেখবে। তোমার তো কেউ ওখানে নেই। তোমার কিছু হলে কে দেখবে? যাহোক রাখলাম। আবার এক ভদ্রলোকের আসার কথা আছে। আমার চেনা অনেকদিনের। দেখি আবার কখন আসে।‘ বলে মিতা ফোন রেখে দিলো।
এই হোল মিতা। বকতে মা, সোহাগ জানাতে স্ত্রী, ঝগড়া করতে বন্ধু। কতকিছু সামগ্রিক চিন্তা করে। মিতা মিতাই। কিন্তু দুশ্চিন্তা আমার এখন অন্যখানে। এক ভদ্রলোকের আসার কথা, তাও অনেকদিনের চেনা। কে হতে পারে? আমি কি চিনি। জিজ্ঞেস তো করা হোল না। জিজ্ঞেস করার সুযোগও পেলাম না। বলেই তো ফোনটা রেখে দিল। তাহলে কি অনির্বাণ আসছে? বলল অনেকদিনের চেনা। অনির্বাণের সাথে তো চেনাজানা অনেকদিন হয়ে গেছে। মিতা কি সাহস পাবে অনির্বাণকে ঘরে ডাকার? কে জানে। যাহোক মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। মিতার ব্যাপার ওই বুঝুক।
আমি ফিরে এলাম। এরা সব চা শেষ করে অপেক্ষা করছে। আমি বিল দিয়ে সবাইকে নিয়ে গাড়িতে বসলাম। গাড়ি আবার স্টার্ট হোল, চলতে লাগলো দ্রুত গতিতে। আমরা সবাই আগের মতই বসলাম।
বিদিশা জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছে মিতা?’
আমি বললাম, ‘ভালো আছে।‘
আবার ও জিজ্ঞেস করলো, ‘সামনে ওর কোন প্রোগ্রাম আছে নাকি?’
আমি নির্বিকার উত্তর দিলাম, ‘তাতো বলল না। আমি আনগুল যাচ্ছি শুনে আমাকে বলল পুরী ঘুরে আস্তে। কোন হোটেল ভালো সেসব দেখে আসতে।‘
নিকিতা হেসে বলল, ‘ওমা তাই। তাহলে নিশ্চয়ই বৌদির পুরী প্রোগ্রাম আছে। ওয়াও বৌদি।‘
বিদিশা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘গৌতম তুমি কি চিন্তিত? দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।‘
আমি জবাব দিলাম, ‘আরে আমার আবার চিন্তা কি? তোমরা আছো সাথে, মজা করছি, ঘুরছি। চিন্তা কেন হবে?’
বিদিশা নাছোড়বান্দা, চেপে ধরল, ‘উহু, আমি তোমাকে জানি। তোমার মতো জলি ছেলে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাবে হতেই পারে না। বাড়িতে কোন প্রব্লেম?’
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলাম, ‘না না বাড়িতে কোন প্রব্লেম নেই।‘
বিদিশা বলল, ‘তাহলে বোলো, আমরা কি তোমার বন্ধু নই? আমরা কি তোমার সমস্যা শুনতে পারি না?’
নিকিতা বলল, ‘আরে গৌতম বোলো না। তুমি তো দেখছি মজাটাই মাটি করে দেবে। কি দরকার ছিল তাহলে পুরী আসার মজা করার জন্যই তো? তোমার প্রবলেমটা বোলো, যদি আমরা কোন সুরাগ দিতে পারি।‘
আমি কেশে গলা সাফ করে বললাম, ‘ফোন রেখে দেবার আগে মিতা বলল জানাশোনা কেউ একজন আসছে ঘরে। মানে কোন ভদ্রলোক, অথচ আমাকে নামটা বলল না। ফোন রেখে দিলো। জানাশোনার ব্যাপার থাকলে তো আমি নিশ্চয়ই করে চিনবো। কিন্তু ও নামটা বলল না কেন?’
বিদিশা হেসে মামলা সহজ করতে চাইল, ‘আরে এই ব্যাপার? কতো কিছু থাকতে পারে এর পিছনে। যেমন ধর ওর মনে নেই যে তার পরিচয় তোমাকে দিতে হবে। কিংবা হয়তো ও মনে করেছে যদি তোমাকে ও বলে তুমি ফালতু চিন্তা করবে যখন তুমি অফিসের কাজে ট্যুরে আছো। কিংবা এও হতে পারে যে ভদ্রলোকে তুমি হয়তো আদৌ চেন না। কতো কিছু হতে পারে। আবার এটাও হতে পারে ও হয়তো অনির্বাণকে ডেকেছে। হতে পারে আমি বলছি, হতেই পারে এটা কিন্তু বলিনি।‘
আমি বললাম, ‘তোমার শেষ কথাটাই হয়তো ঠিক। অনির্বাণ হয়তো আসছে। তাই ও নাম বলেনি।‘
বিদিশা আমাকে বলল, ‘আচ্ছা আমাকে একটা উত্তর দাও। দেবে?’
আমি বললাম, ‘প্রশ্ন করো।‘
বিদিশা বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি যখন এখানে এসেছিলে তুমি কি মিতাকে বলে এসেছ যে আমরাও আসছি?’
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম, ‘আরে তুমি কি বোকা নাকি। সে কখনো ওকে বলা যায়?’
বিদিশা বলল, ‘নিশ্চয়ই যায় না বিশেষ করে যেখান বিশ্বাসটা বড়। অথচ ও কিন্তু তোমাকে সন্দেহ করে নি যে তুমি কাউকে নিয়ে আসতে পারো। তোমাকে ও বিশ্বাস করে বলে। তুমি যে বিশ্বাস ভেঙেছ ওর সেটা বলছি না। কারন তোমরা তোমাদেরকে ভালো করে চেন। অনেক কিছুই হয় তবু লোকের বিশ্বাস এক জায়গায় থেকে যায়। তুমি কিন্তু ওকে একবারের জন্যও হিন্ট দাও নি যে তুমি কারো সাথে যেতে পারো। ও কিন্তু তোমাকে বলেছে যে কোন একজন ওর খুব চেনা সে আসছে। তাতে তুমি এতো বিমর্ষ হয়ে পরেছ কেন? হতে পারে অনির্বাণ আবার নাও হতে পারে। যদি অনির্বাণ হয় তাহলে ও মিতার বন্ধু তোমার নয়। আমরা তোমার বন্ধু মিতার নয়। আমাদের কথা যেমন তুমি ওকে বলোনি তেমনি ও তোমাকে বলেনি। এটা একটা সম্ভবনার কথা বলছি।‘
নিকিতা বিদিশাকে সমর্থন করলো, বল্লম ‘দিদি একশো ভাগ ঠিক বলছে। এতে তো এতো চিন্তার কারন দেখছি না। আসলে জানো গৌতম তোমরা ছেলেরা নিজেদেরকে বিশ্বাস করতে শেখনি। তোমরা সমাজ ব্যবস্থা এমন করে রেখেছ, তোমরা বলছি এই কারনে যে আজো সমাজ মুলত ছেলেদের দ্বারাই পরিচালিত হয়। যাহোক তোমরা সমাজকে এমন করে রেখেছ যে তোমরা যে কোন ধরনের কাজ করতে পারো তাতে মেয়েরা ভ্রূকুটি পর্যন্ত করতে পারবে না। অথচ মেয়েরা ওদের সুখের জন্য কোন কিছু করলেই সেটা তোমরা মেনে নিতে পারো না। মেয়েদেরকে তোমরা পায়ে বেরি পরিয়ে রেখেছিলে, রাখছ আর রাখতে চাও। এটা অন্যায়। আমার মতে।‘
আমি ওদের কথা ঠিক শুনছিলাম না। আমি বিদিশার একটা কথা ভাবছিলাম। যে লোকটা আসছে সে অনির্বাণ হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। আমি যখন এখান থেকে জানতেই পারছি না তাহলে অকারনে কেন চিন্তা করছি। কেন চিন্তা করে এই নির্দোষ মেয়েগুলোর খুশি ছিনিয়ে নিতে চাইছি? এটা ঠিক নয়। যেন ওদের কথা শুনলাম, বললাম, ‘হ্যাঁ তোমরা ঠিক বলেছ। ছেড়ে দাও। ডোন্ট ওরি বি হ্যাপি। চলো আমরা সবাই মিলে আনন্দ ছড়িয়ে দিই চারপাশে।
মহল ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম। জানলার কাঁচটা একটু নিচে করে দিলাম যাতে গাড়ীর ভিতরটা ধোঁয়া ধোঁয়া না হয়ে যায়। একটা গান ধরলাম, “এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো? যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো?”
গানটা গাইতে গাইতে ভাবছিলাম এতে বলার কি আছে, সবাই খুশি থাকতো। তাহলে হয়তো জীবনের খুশীর জন্যও সবাইকে অন্বেষণ করতে হতো না।
(চলবে)
0 Comments