আপু ব্যাগ, পার্স কিছুই নিয়ে আসেনি, সঙ্গে সম্ভবত কোন টাকা পয়সাও নেই। মানিব্যাগ বের করে ভাড়া দিলাম। ভাগ্যিস টাকা পয়সা কিছু এনেছিলাম।
বাস থামল স্টেডিয়ামের কাছে। চারদিকে কড়া নিরাপত্তা, লোকজন গিজগিজ করছে। টিকিটদুটো বের করে চার নাম্বার গেটের দিকে এগোলাম। বিশাল লাইনে অসহিষ্ণুভাবে দর্শকরা দাঁড়িয়ে আছে। চেকআপ টেকআপের পর একজন একজন করে ভেতরে ঢুকতে পারছে। লাইনের ভেতরে দাঁড়িয়েই অনেকে ব্ল্যাকে টিকিট বেচা লোকেদের সঙ্গে দর কষাকষি করছে। কাঠফাটা রোদে মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে থাকার পর লাইন স্টেডিয়াম গেটের ভেতর প্রবেশ করল। আমার পেছনে আপু দাঁড়িয়েছিল। পেছন থেকে শুধুশুধু লোকজন সামনে ঠেলাঠেলি করছে। আপু আমার ঘাড়ে হাত রেখে ব্যালেন্স করছে। নরম বুক ঘামে ভেজা পিঠের সঙ্গে লেপ্টে যাচ্ছে মাঝেসাঝে। স্টেডিয়ামে মেয়েমানুষ খুব একটা আসেনা। নারীসঙ্গ বঞ্চিত বাঙালি টিশার্ট ট্রাউজার পড়া যুবতী মেয়ে দেখে হাঁ করে চেয়ে আছে। খেলা শুরু হয়ে গেছে। ভেতর থেকে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। আপু কয়েকবার আমার পিঠের উপর ঢলে পড়ল। তারপর পেছন ফিরে বিরক্তি নিয়ে ভালমানুষের মত মুখ করে দাঁড়ানো মাঝবয়েসি লোকটির দিকে তাকিয়ে আমাকে ডাকল,
- আকাশ, আমার পিছনে দাঁড়া তো!
বিনা বাক্যব্যয়ে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লাইন যতই সামনে এগোচ্ছে ততই মন্থর হয়ে যাচ্ছে, পেছন থেকে ধাক্কাও বাড়ছে। অনেক চেষ্টা করেও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছেনা। আপুর পিঠের ওপর চাপ পড়ছে, পিঠে চাপ পড়ার আগে ধাক্কা লাগছে সুউচ্চ নিতম্বে। মনে মনে বিব্রতবোধ করছি, তবে আপু কিছু বলছেনা।
অবশেষে দুই স্তর বিশিষ্ট চেকপয়েন্ট মাড়িয়ে ভেতরে ঢোকা গেল। গ্যালারি টিকেটের দাম কম, তবে আপু যেরকম সৌখিন মানুষ গ্যালারির উত্তাল পরিবেশে বিরক্ত হয়ে যায় কিনা তাই প্রচুর পয়সা খরচা করে ক্লাব কর্ণারের টিকিট যোগার করেছি। ছায়াঢাকা এক প্রান্তে কিছু আসন খালি ছিল। সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম দুজন পাশাপাশি। গরমে ঠেলাঠেলির পর পানির তৃষ্ণা পেয়েছে, আপুও বলছে পানির ব্যবস্থা করতে। পানির ব্যবস্থা করা কোন ব্যাপার না, তবে স্টেডিয়ামের ভেতর দশ টাকার পানির বোতল যেভাবে ত্রিশ-চল্লিশ টাকা হয়ে যায় তাতে মেজাজ বেশ খারাপ হয়। ঢকঢক করে পানি গিলে খেলার দিকে মনযোগ দিলাম। ভারতের ব্যাটিংয়ের পুরোটা সময় জুড়ে লাফালাফি করার মত কিছুই ঘটেনি। দুই ব্যাটসম্যানের জোড়া সেঞ্চুরিতে রানের পাহাড় গড়েছে প্রতিপক্ষ। বিরতির সময় খাবারের ব্যবস্থা করতে বেরোলাম। স্টেডিয়ামের ভেতর পানির মত খাবারেরো আগুন মূল্য। আপুর কিছুই পছন্দ হলনা। খাবার টাবার বাদ দিয়ে ফিরে গেলাম খেলা দেখতে। তামিম সাকিবদের মারমুখী ব্যাটিং সবাই বেশ উপভোগ করল, কিন্তু পাটকাঠির মত লোয়ার অর্ডার নিয়ে ৩৭০ তাড়া করা সম্ভব নয়। শেষটা যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, সবাই তত বেশি চুপ মেরে যেতে থাকল। আপু গোমড়া মুখ করে অস্থিরভাবে আমার পায়ের উপর চাটি মেরে চলেছে। কোন কিছু নিয়ে আপসেট হলে আমাদের কারো গায়ে আনমনে চাটি মারা তার অভ্যাস, কখনো কখনো আলতো করে লাথিও মারে! দুয়েকটা চার হলে লাফিয়ে উঠছিল, উত্তেজনায় আমার উরু খামছে ধরছিল। তবে অমনটা খুব বেশি হবার সুযোগ পেলনা। অনেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অনুধাবন করতে পেরে।
- চল!
আপুও অবশেষে উঠে দাঁড়াল। চুপচাপ তাকে অনুসরণ করে রাতের মিরপুরে বেরিয়ে এলাম। বাস পেতে সময় লাগল। মহিলাসহ বাঁদড়ঝোলা বাসে ওঠা সম্ভব না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সিএনজি যোগার করা গেল একটা। রাতের ঘন আঁধার কেটে বাসার দিকে ছুটে চলেছে অটোরিক্সা। জ্যাম পেরিয়ে বেড়িবাঁধের খোলা রাস্তায় উঠার আগেই আপু ঝিমুতে শুরু করল। একসময় আমার ঘাড়ে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অনেক্ষণ ধরেই এমনটা হচ্ছিল বলে লক্ষ্য করিনি, এবার সিএনজিওয়ালা পেছনে তাকিয়ে বলল "আপা তো পইড়া যাইতাছে, ধরেন!"
তুরাগের পানিতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আলোঝলমল স্টীমার থেকে চোখ ফিরিয়ে আপুর দিকে খেয়াল করলাম। কিভাবে "ধরব" ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, পরে ডান হাত আপুর গলার পেছন দিয়ে মুড়িয়ে বাহু চেপে ধরলাম। এভাবে আধঘন্টার মত পার হল, বাড়ির সামনে অটোরিক্সা থামল। আমার কাছে ভাড়া নেই, আপু চোখ কচলাতে কচলাতে উপরে উঠল ভাড়া আনতে।
- আপার মন খারাপ, বাংলাদেশ হারছে!
শুকনোমত সিএনজিওয়ালা চুকচুক করে করুণ হেরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল। আমি ঠোঁট উল্টে বোঝালাম, হয়তো তাই হবে।
আপু ভাড়া নিয়ে নেমে এল। চোখেমুখে পানি দিয়েছে, অনেকটা ফ্রেশ দেখাচ্ছে। সিএনজিওয়ালা গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে আমিও বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম। সারা দেহে ক্লান্তি চেপে বসেছে, বিছানায় গা এলিয়ে দিতে মন চাইছে।
- ঐ, কই যাস!
আপু চেঁচিয়ে উঠল।
- বাসায়..
পেছন তাকিয়ে বললাম।
- যাওয়া লাগবনা, উপরে আয়। আন্টিরে ফোন করে বলে দিতেছি। বাসায় কেউ নাই, তুই থাক এইখানে।
- তুমি ভয় পাও কবে থেকে আবার! আমার ঘুমে ধরছে।
বিরক্ত হয়ে বললাম। কারণ এখন উনার সঙ্গে গেলে খেলা নিয়ে প্যাঁচাল পাড়তে শুরু করবেন এবং আমাকেও তাতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করবেন।
0 Comments