‘ঠিক আছে, আমি তো এই অসুধটা লিখে দিলাম, এটা আনাবার ব্যবস্থা করুন...’
‘এটা এক্ষুনি আনিয়ে নিচ্ছি... কি মনে হচ্ছে আপনার?’
বেশ কয়একটা অপরিচিত গলার স্বরে চোখ মেলে পৃথা... চোখ খুলেই ফের বন্ধ করে নেয় সাথে সাথে, কাঁচের জানলার শার্শির ভিতর দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে পড়া দিনের উজ্জল আলো চোখের ওপরে পড়ার ফলে... তারপর আবার ধীরে ধীরে চোখ খোলে সে... বিছানার পাশে প্রণববাবুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে, আর তাঁর সাথে আরো একজন অপরিচিত বেশ বয়ষ্ক ভদ্রলোক... ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় প্রণববাবুর পানে...
‘এই তো উনি উঠে পড়েছেন...’ পৃথাকে চোখ খুলতে দেখে বলে ওঠেন প্রণববাবু, তারপর তাকে উদ্দেশ্যে করেই বলেন, ‘আর চিন্তা করার কিছু নেই মিস মুখার্জি... ডাক্তারবাবু আপনাকে দেখে নিয়েছেন, অসুধ পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে...’
‘ডাক্তার?’ প্রশ্ন ভরা চোখে তাকায় অপরিচিত ভদ্রলোকের দিকে।
‘হ্যা মা... আমি ডাঃ বসাক... তুমি একটু হাতটা বের করো তো... একটা ইঞ্জেকশন দেবো... ইঞ্জেকশনে আশা করি তোমার কোন ভয় নেই...’
ডাক্তারের কথার কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বাঁ হাতটাকে চাঁদরের নিচ থেকে বের করে এগিয়ে দেয় পৃথা... ফের তাকায় প্রণববাবুর পানে... প্রণববাবু হাত তুলে ওকে আস্বস্থ করে ইশারায়... ততক্ষনে টি-শার্টের হাতাটাকে বাহুর ওপরে খানিকটা তুলে স্পিরিটে ভেজা তুলো ঘসতে শুরু করে দিয়েছেন ওই ডাক্তার।
ইঞ্জেকশন দেওয়া হলে, সোজা হয়ে দাঁড়ান ডাক্তারবাবু, প্রণববাবুর দিকে ফিরে বলেন, ‘আর কোন ভয় নেই, সামান্যই জ্বর... আমিও একটা প্যারাসিটামল ইঞ্জেক্ট করে দিলাম, তাতে একটু তাড়াতাড়ি কাজ হবে, আশা করছি দুই একদিনের মধ্যেই একেবারে ঠিক হয়ে যাবে... সামান্যই ঠান্ডা লেগে জ্বর... তবে এই অসুধগুলো আনিয়ে নিন...’ তারপর পৃথার দিকে ফিরে বলে, ‘কোন চিন্তা নেই মা, সব ঠিক হয়ে যাবে, কেমন? নরমাল থাকবে... কোন অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করবে...’ বলে নিজের ব্যাগ গোছাতে থাকেন।
‘উনি আজকে কি স্নান করবেন?’ ফের প্রশ্ন করেন প্রণববাবু।
‘হ্যা, হ্যা... করবে না কেন? তবে আজকের দিনটায় একেবারে ঠান্ডা জলে না করে একটু ইষদ্উষ্ণ জল করে নেবেন’খন...’ বলে ব্যাগ গুছিয়ে দরজার দিকে এগোতে থাকেন... ওনার সাথে প্রণববাবুও এগিয়ে যান... পৃথা বিছানায় শুয়ে চুপচাপ দেখতে থাকে ওদেরকে।
ডাক্তারকে দরজা অবদি এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসে প্রণববাবু পৃথার কাছে, ‘আমি তাহলে অসুধগুলো আনাবার ব্যবস্থা করি গিয়ে... আপনি একটু শুয়ে রেস্ট নিন...’ বলে ফিরে যেতে উদ্যত হন।
‘এক মিনিট মিঃ কর্মকার... আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো আমাকে, আমার জ্বর, সেটা আপনি জানলেন কি করে?’ প্রশ্ন করে পৃথা।
পৃথার প্রশ্ন একটু থমকান ভদ্রলোক, আমতা আমতা করে বলেন, ‘না, মানে, ওই তো... সকাল বেলায় আপনার মেসেজ পেয়েই তো জানতে পারলাম...’
‘আমার মেসেজ পেয়ে?’ অবাক হয়ে তাকায় পৃথা। উঠে বসার চেষ্টা করে সে। এখন অনেকটাই আগের থেকে ভালো লাগছে তার।
তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে এসে পৃথার পেছন থেকে বালিশটাকে টেনে খাটের রেস্টবোর্ডের ওপরে কাত করে রাখেন প্রণববাবু, পৃথা পিছিয়ে গিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসে ফের জিজ্ঞাসা করে, ‘আমার মেসেজ পেয়েছিলেন? সেটা কি করে সম্ভব? আমি কখন আপনাকে মেসেজ করলাম, আর আপনাকেই বা করব কেন?’
কাঁধ শ্রাগ করে ভদ্রলোক বলেন, ‘সে আমি কি করে জানবো বলুন, তবে এই তো দেখুন না...’ বলতে বলতে নিজের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে মেসেজ লিস্ট খুলে পৃথার সামনে তুলে ধরেন উনি।
পৃথা চোখ সরু করে দেখে সত্যিই তার নাম্বার থেকেই মেসেজটা গিয়েছে --- ফিলিং ফিবারিশ... প্লিজ কাম শার্প... --- অবিশ্বাসী চোখে ফের তাকায় প্রণববাবুর দিকে... নিজেই বিড়বিড় করে বলে ওঠে, ‘আমি করলাম মেসেজ? কিন্তু... কখন?’ ফের তাকায় সামনে মেলে রাখা মেসেজটার দিকে... তারপরই যেন হটাৎ করে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়... মুখটা সহসা উজ্জল হয়ে ওঠে... স্মিত হেসে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘হুম... বুঝেছি... আর কিছু বলতে হবে না...’।
প্রণববাবুও ফের যাবার জন্য ঘোরেন... কিন্তু পেছন থেকে পৃথার আবার প্রশ্ন ভেসে আসে, যেন নিজে কিছু ব্যাপারে সঠিক হবার জন্যই প্রশ্নটা তাঁকে করা, ‘আচ্ছা মিঃ কর্মকার, আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল...’
‘হ্যা, বলুন...’ আর একটা কোন অস্বস্থিকর প্রশ্ন আসছে বুঝে গোবেচারার মত মুখ করে ঘুরে দাঁড়ান ভদ্রলোক...
‘আপনাকে দরজা কে খুলে দিল মিঃ কর্মকার?’ চোখটাকে তীক্ষ্ণ করে তাকিয়ে থাকে প্রণববাবুর মুখের পানে পৃথা।
‘দরজা...’ ঢোক গেলেন ভদ্রলোক... ‘না... মানে... বোধহয় খোলাই ছিল... মনে হয়...’ কোন রকমে আমতা আমতা করে জবাব খোঁজার চেষ্টা করেন।
আর কিছু বলে না পৃথা... ঠোঁটের হাসিটা আরো খানিকটা শুধু চওড়া হয় তার মুখের... সারা শরীরটা একটা ভিষন ভালো লাগায় ভরে ওঠে... অসম্ভব হাল্কা লাগে নিজেকে... শরীরের সমস্ত কষ্ট যেন নিমেশে উধাও হয়ে গিয়েছে... বেডরুম থেকে দ্রুত পায়ে প্রণববাবুকে বেরিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখের দৃষ্টিতে মিশে থাকে কৌতুক।
ভদ্রলোক বেডরুম থেকে বেরিয়েই ফের ফিরে আসেন, সাথে একটি মেয়ে... ‘ওহ! মিস মুখার্জি... এ হচ্ছে কাজল...’
পৃথা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় মেয়েটির দিকে... ছোট্ট খাট্টো চেহারার গোটা কুড়ি বছরের মেয়েটি... গায়ে একটি কম দামী হলেও বেশ পরিষ্কার চুড়িদার পরে রয়েছে... মুখটা বেশ মিষ্টি... মাথায় সিদুরের হাল্কা চিহ্ন প্রমাণ দেয় যে মেয়েটি বিবাহিত... এত অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছে?... অবস্য এদের আর্থসামাজিক অবস্থানে সেটাই স্বাভাবিক... পৃথা নজর করে মেয়েটিও এক নজরে তাকিয়ে রয়েছে তারই দিকে...
‘এ... কে? মিঃ কর্মকার?’ প্রশ্ন করে পৃথা।
‘মানে, ও আগে এই ফ্ল্যাটেই অর্নবের কাছে কাজ করতো... খুব বিশ্বাসী... এই কাছেই থাকে... অনেক ছোট বেলায় এসেছিল... এখন তো অনেক বড় হয়ে গেছে, বিয়েও হয়ে গিয়েছে... খুব ভালো মেয়ে... মাঝের কিছুদিন ওই ইন্সিডেন্টটা ঘটার পর আমরা আসতে বারণ করে দিয়েছিলাম, কিন্তু আজ তাই ওকে আবার সাথেই নিয়ে এসেছি... আজ থেকে ও আপনার কাছেই কাজ করবে... আপনার কোন অসুবিধা হবে না... খুব কাজের মেয়ে... সব কিছু সামলে নেবে...’ এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলেন ভদ্রলোক।
‘কিন্তু আমি একা থাকি... সেখানে ও...’ কথা শেষ হয় না পৃথার, তার আগেই প্রণববাবু বলে ওঠেন, ‘আপনি একা থাকেন বলেই তো ওকে আনা... আপনার হাতে হাতে থাকবে... দেখবেন আপনার খুব উপকারে লাগবে... এমনিতেই বুঝতে পারি যে এই ভাবে সংসারের কাজ করার অভ্যাস নেই আপনার, আর তাছাড়া আপনি অফিস করেন, সেখানে এই ধরনের একটা হেল্পিং হ্যান্ড আপনার খুব উপকারে লাগবে...’ বলেই কাজলের দিকে ফিরে বলেন, ‘দিদিমনিকে সব সময় দেখাশুনা করবি, বুঝেছিস... ওনার যেন কোন অসুবিধা না হয়... যা বলবেন, মন দিয়ে শুনবি... কেমন?’
ঘাড় হেলায় কাজল, প্রণববাবুর কথায়।
‘না, সে তো না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমি তো অফিস বেরিয়ে যাবো... ও কি সারাদিন থাকবে?’ জিজ্ঞাসা করে পৃথা।
‘না, না, ও সকালে আসবে, আপনি বলে দেবেন কখন আসলে সুবিধা হবে আপনার... সেই মতই সময় করে এসে কাজ করে দিয়ে যাবে... রান্নাটাও খুব ভালো করে ও... সেটাও সামলে নেবে... আর সন্ধ্যেবেলাতে আপনি অফিস থেকে ফিরলে না হয় ও আরো একবার আসবে’খন...’ বলেন প্রণববাবু।
‘আমার দরকার খুব একটা যে ছিল তা নয়... একাই তো বেশ চালিয়ে নিচ্ছিলাম... হ্যা, মাঝে অবস্য ভাবছিলাম যে একটা লোক পেলে ভালো হয়, কিন্তু... আচ্ছা, ঠিক আছে... তবে সকালে আসলেই হবে, সন্ধ্যেবেলায় আর আসার প্রয়োজন নেই... আমি একা মানুষ... এক বেলা একটু হাতে হাতে কাজ করে দিলেই হবে...’ বলে কাজলের দিকে ফিরে বলে, ‘কি পারবে তো?’
ঘাড় হেলিয়ে বলে ওঠে মেয়েটি, ‘হ্যা, হ্যা, দিদিমনি, দেকবেন আপনার কোন অসুবিদা হবে না... আপনি যেমনটি বলবেন, আমি ঠিক তেমনটি করে দেব...’
‘হু... বুঝলাম... তা মাইনে কত নেবে?’ মনে মনে ভাবে পৃথা, এটাই আসল প্রশ্ন।
‘ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না... ওটা ওর সাথে আমার কথা হয়ে গিয়েছে...’ তাড়াতাড়ি করে উত্তরটা দেয় প্রণববাবু।
ভুরু কোঁচকায় পৃথা, ‘আমার কাজ করবে আর ওর মাইনে নিয়ে আমি চিন্তা করবো না, মানে? সেটা আবার হয় নাকি?’
‘না, মানে... সেটা বলতে চাইনি ঠিক... আসলে ও আগে যা মাইনে তে কাজ করতো, সেটাই ও পাবে... তাতেই ও রাজি...’ কাঁচুমাচু মুখে উত্তর দেয় ভদ্রলোক।
‘না, সেটা কত, সেটা তো আমাকে জানতে হবে... মাইনেটা তো আমি দেব... আপনি তো আর নয়...’ বলে পৃথা।
‘হ্যা, সেটা তো বটেই... ওই দেড় হাজার টাকা ও পেতো আগে...’
‘দেড় হা-জা-র? এটা একটু বেশিই নয় কি প্রণববাবু?’ টাকার অ্যামাউন্টটা শুনে একটু যেন অসন্তুষ্ট হয় পৃথা।
‘না মানে, ও আগে এটাই তো পেতো, তাই... তবে সব কাজই ও করবে... সব... রান্নাটাও করে দেবে আপনাকে...’ কাজলের হয়ে সাফাই গায় প্রণববাবু। ওনার কথার ধরন দেখে পৃথার যেন মনে হয় কাজলকে কাজে রাখার ব্যাপারটায় ওনার ওপরে আর কারুর কড়া নির্দেশ রয়েছে, তাই যে করেই হোক কাজলকে কাজে বহাল করতেই হবে। তারপরই দুম করে বলে বসেন, ‘আচ্ছা, আপনি ওকে পাঁচশ টাকাই দেবেন’খন...’
অবাক হয় পৃথা, ‘একেবারে দেড় হাজার থেকে পাঁচশতে নেবে গেলেন... ব্যাপারটা কি হলো? বাকি টাকাটা কে দেবে? আপনি?’
‘সে আপনাকে ভাবতে হবে না... ওটা ঠিক হয়ে যাবে...’
‘না, না, মিঃ কর্মকার, ঠিক হয়ে যাবে মানে? ও আমার কাজ করবে আর মাইনের বাকি টাকা অন্য কেউ দেবে... এটা আবার কেমন কথা?’ চোখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে পৃথা।
পৃথার মনে হল যেন ভদ্রলোককে কেউ ফাটা বাঁশের মধ্যে আটকে দিয়েছে... ব্যাপারটা নিয়ে এতটা জল ঘোলা হবে, সেটা বোধহয় উনি ঠিক আশা করেন নি... তাই কি বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না... ওনার অবস্থা দেখে মনে মনে হাসে পৃথা, কিন্তু মুখের সিরিয়াস ভাবটা সরায় না... এবার কাজলের দিকে ফিরে বলে, ‘ঠিক আছে... বুঝেছি... তুমি ওই দেড় হাজারই পাবে... ওটাই আমি দেব... তবে ঠিক মত কাজ করবে তো? আর হ্যা, রান্না সবসময় করার দরকার নেই, ওটা আমিই করে নেবো’খন... আমার রান্না করতে ভালোই লাগে, শুধু একটু হাতে হাতে এগিয়ে দিলেই হবে, বাকিটা আমিই সামলে নেব।’
এত্তো বড় একটা ঘাড় নেড়ে বলে ওঠে কাজল, ‘এক্কেবারে দিদিমনি... কোন এদিক সেদিক হবে না... এক্কেবারে ফাস্ট কেলাস কাজ পাবেন...’
ওর ফাস্ট কেলাস বলার ধরনে আর হাসি চেপে রাখতে পারে না পৃথা, ফিক করে হেসে ফেলে। ওকে হাসতে দেখে প্রণববাবুও হাসেন।
‘একটা কথা ভাবছিলাম মিঃ কর্মকার, কাজল যে আমার কাছে কাজ করবে, তাহলে ও অন্য বাড়ির কাছ কি হবে? প্রশ্ন করে পৃথা।
প্রণববাবু কিছু বলার আগেই উত্তরটা দেয় কাজলই, ‘ও সব তুমি চিন্তা কোরো না দিদিমনি, আমি সব সামলে নেব... আজকে তো ফোন করে বলেই দিয়েচি যে আমি আজ যাবো না... আমার পেট খারাপ হয়েচে... আর কাল থেকে আমি সব ঠিক করে নেব... আগে সকালে এসে তোমার কাজ সারবো, তারপর অন্য বাড়ি যাবো...’
‘কিন্তু আমার তো ব্যাপারটা খারাপ লাগছে না... অন্য বাড়ির লোকেরাও অপেক্ষা করবে তোমার জন্য... আর এই ভাবে হুট করে যদি...’ বলার চেষ্টা করে পৃথা।
‘বলচি তো দিদিমনি... সব আমার ওপরে ছেড়ে দাও... দাদাবাবুর বাড়ি আগে আসবো... তারপর সব...’ হাত তুলে মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করে কাজল। পৃথাও আর কথা বাড়ায় না।
‘আমি তাহলে আসি মিস মুখার্জি... কাজল রইলো তাহলে, কেমন...’ বলে প্রণববাবু দ্রুত বেরিয়ে যান বেডরুম থেকে... পৃথার কানে আসে বাইরের দরজাটার বন্ধ হয়ে যাবার আওয়াজ।
গায়ের চাদরটাকে সরিয়ে বিছানার থেকে নামতে উদ্যত হয়... ঘুম ভাঙার পর থেকে ঘরের মধ্যে এত লোক থাকার ফলে সকালের বাথরুমটা আর তার সারা হয়ে ওঠে নি এখনও, তলপেটটা ভারী হয়ে রয়েছে... একবার না গেলেই নয়... কিন্তু চাঁদর সরাতে গিয়েই থমকায়... ঘরের মধ্যে কাজল এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর সে কাল যখন শুয়েছিল, তখন শুধু মাত্র টি-শার্টটাই গায়ে চাপিয়েছিল, তার মানে... ভাবতে ভাবতে চাঁদরের খুটটা ধরে তুলে ভেতর দিকে নজর ফেলে... কিন্তু যা দেখে তাতে আর তাকে কাজলে সামনে অস্বস্তিতে পড়তে হবার কোন কারণ পায় না... পায়ে ওর একটা প্রিন্টেড পাতলা কটন পায়জামা পরা... তারমানে পরে কেউ... আবার একটা হাসি খেলে যায় ঠোঁটে... আর কিছু না ভেবে এবার নিশ্চিন্দে শরীরের ওপর থেকে চাঁদরটা সরিয়ে দিয়ে পা নামায় বিছানার থেকে... তারপর মেঝের দিকে তাকিয়ে খোঁজে কিছু...
‘কিচু খুঁজচো দিদিমনি?’ প্রশ্ন করে কাজল।
‘উ... না...’ আনমনে উত্তর দেয় পৃথা... আসলে ও খোঁজার চেষ্টা করছিল কালকের রাতে এনে রাখা বালতিটা... যেটাতে ওর মাথা ধুইয়ে দেওয়া হয়েছিল জ্বরের সময়... কিন্তু সেটার দেখা পায় না, শুধু শুকিয়ে যাওয়া কিছু জলের রেশ পড়ে থাকতে খেয়াল করে মেঝেতে। সন্তর্পনে উঠে দাঁড়ায় বিছানার থেকে... কিন্তু উঠে দাঁড়াতেই টলে যায় মাথাটা... বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে এই একটা রাতের মধ্যেই।
দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ধরে নেয় কাজল পৃথাকে... ‘সাবধান দিদিমনি... তোমার সলিলটা একোনো খুব দুব্বল...’
কাজলের তৎপরতা দেখে ভালো লাগে পৃথার... হেসে বলে, ‘হু, ঠিক বলেছ... বুঝতে পারিনি এতটা দুর্বল হয়ে গেছি... থ্যাঙ্কস্...’
‘বাব্বা... থ্যাঙ্কুয়ের কি আচে গো? তুমি টলে গেলে, আর আমি ধরবো না? কলঘরে যাবে তো? চলো, আমি তোমায় নিয়ে যাই...’
‘না না, তোমাকে আবার যেতে হবে না... আমি নিজেই যেতে পারবো ঠিক...’ বলে ফের চেষ্টা করে এগোবার... কিন্তু কাজল পৃথার হাত ছাড়ে না... ‘না না দিদিমনি... একোন পারবে না... তুমি আমাকে এত পর পর ভাবচো কেন? দেকো, আমি কিন্তু এ বাড়িতে নতুন না... একানের সব কিচু আমার চেনা... তুমি কোনো চিন্তা কোরো না... আমি একা হাতে তোমার সংসারটা কেমন গুচিয়ে দিই দেকবে... কোন বোলতি থাকবে না...’
‘আমার সংসার গুছিয়ে দেবে...?’ কাজলের কথায় হেসে ফেলে পৃথা... আর কথা বাড়ায় না... ধীর পায়ে বাথরুমের দিকে অগ্রসর হয় কাজলের হাত ধরে। ওকে একেবারে বাথরুমের মধ্যে নিয়ে যায় কাজল, হাত বাড়িয়ে দেওয়ালটাকে ধরে পৃথা বলে, ‘এবার তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও কাজল, আমি ঠিক আছি...’
‘ঠিক বলচো তো দিদিমনি... পারবে তো?’ তবুও নিসন্দেহ হতে চায় কাজল।
‘হ্যা রে বাবা হ্যা... তুমি যাও দিকি...’ হাসি মুখেই ধমকায় কাজলকে। কাজল ওকে ছেড়ে বাথরুমের বাইরে এসে দাঁড়ায়, ‘আমি একানেই দাঁড়িয়ে রইলুম... তোমার হলে বলো, আবার নিয়ে যাবো...’
কোমর থেকে পায়জামাটা নামিয়ে কোমডে বসে পৃথা... বসার সাথে সাথেই ছরছর শব্দে জমে থাকা শরীরের জল বেরিয়ে আসে... এই রকম শব্দ হওয়াতে কেমন লজ্জা লাগে ওর... আগে একা থাকতো, তাই যেমন খুশি তেমনি ভাবেই চলতো... কিন্তু এখন বাথরুমের বাইরেই কাজল দাঁড়িয়ে... যদি হিসি করার আওয়াজ শোনে? অস্বস্তি হয় তার, কিন্তু কি আর উপায়!
ফ্ল্যাশের আওয়াজ পেতেই কাজল দরজা ঠেলে বাথরুমে ঢোকে... তখনও ও নিজের পায়জামাটা তোলার সুযোগ পায় নি... দুম করে কাজল ঢুকে পড়াতে থতমত খেয়ে যায়... ওকে এই রকম অপ্রস্তুত হতে দেখে কাজলের কিন্তু কোন হোলদোল দেখা যায় না... এগিয়ে এসে ঝুঁকে পায়জামাটাকে ধরে পৃথাকে পড়তে সাহায্য করে... মনে মনে খুশিই হয় পৃথা। কাজল ওকে ধরে থাকে, আর পৃথা বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁতটা মেজে মুখ ধুয়ে নেয়। তারপর মুখ ধোয়া হলে কাজলকে ধরে ধীর পায়ে ফিরে যায় বেডরুমে।
পৃথাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ের চাঁদরটাকে টেনে দেয় কাজল। তারপর বন্ধ জানলার দিকে এগিয়ে গিয়ে খুলে দেয় শার্শিগুলো... বাইরে তখন আর বৃষ্টি নেই... ঝলমলে রোদ উঠেছে... জানলাটা খুলে দিতেই সকালের মিঠে বাতাসে ঘরটা ভরে যায়। জানলার কাছ থেকে সরে এসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কাজল... পৃথা চুপ করে শুয়ে ভাবতে থাকে কাল রাত থেকে এখন অবধি ঘটনার প্রবাহটাকে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই ফের ফিরে আসে কাজল ঘরের মধ্যে, ‘ঘরে তো সে রকম কিছুই নেই দেকলাম, ফ্রীজও ফাঁকা... আমাকে পঞ্চাশটা টাকা দাও তো...’ বলতে বলতে বিছানার পাশে, পৃথার সামনে এসে দাঁড়ায় সে।
‘টাকা নিয়ে কি করবে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পৃথা।
‘চিকেন আনতে হবে না? আর পাঁউরুটিও আনবো... তোমাকে উনি একোন জ্বরের মুখে ভালো মন্দ খাওয়াতে বলে গেচেন... তাই একোন সকালে তোমাকে চিকেন সুপ বানিয়ে দেব... আর সেই সাথে টোস্ট... তাই একটু বাইরে যেতে হবে ও গুলো আনতে... দাও... টাকা দাও...’ বলে ওঠে কাজল।
পৃথার বুঝতে অসুবিধা হয় না ইতিমধ্যেই কাজল ওর কথামতো সংসারের দ্বায়িত্ব তুলে নিয়েছে... এখন থেকে ওর কথা মতই চলতে হবে তাকে নাকি? কিন্তু কোন বিরক্ত আসে না মনের মধ্যে তার কাজলের এই স্বতস্ফুর্ততায়, সে বলে, ‘বাইরের ঘরে দেখ আমার ব্যাগটা আছে, নিয়ে এসো...’
ঘর থেকে বেরিয়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে ফিরে আসে... ‘আচ্চা দিদিমনি, তুমি আমাকে সেই ফাস্ট থেকে তুমি তুমি করচো কেন বলতো? তুই করে বলতে পারো না? আমাকে তো দাদাবাবু তুই করেই বলতো...’
‘তোমার দাদাবাবু বলতো বলেই আমাকে বলতে হবে?’ হেসে বলে ওঠে পৃথা।
‘হ্যা, বলবে, আর তাচাড়া তুই বলে বললে না বেশ আপন আপন সোনায়... ওই তুমির মধ্যে সেটা থাকে না...’ মাথা নেড়ে নেড়ে বলে কাজল।
‘তাই? তুই বললে আপন শোনায়?’ প্রশ্ন করে পৃথা।
‘সোনাই তো... আমার তুই করে বললেই বেসি ভালো লাগে...’
‘বেশ... তাই না হয় বলবো... আবার যখন তোমার দাদাবাবু বলতো... তখন আমাকে তো বলতেই হবে, তাই তো?’ বলে পৃথা।
‘ডাকতোই তো দাদাবাবু তুই করে... হেব্বি ভালো লোক ছিল, জানো...’ মাথা নেড়ে বলে কাজল।
‘তাই? খুব ভালো লোক ছিল?’ একটু কৌতুহলী হয়ে ওঠে পৃথা।
‘ছিলই তো... কোনদিন কক্কোনো আমাকে বোকতো না... আমিই তো বলতে গেলে সামলাতাম সব কিচু... দাদাবাবু সংসারের কিচ্চুটি দেকতো না...’
‘মানে তুই গিন্নি ছিলিস, বল্...’
‘এ মা, না, না, সেই রকম নয় গো...’ তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে প্রতিবাদ করে ওঠে কাজল।
হাসে পৃথা... ‘বুঝেছি... আমাকে আর বোঝাতে হবে না তোকে, তুই বরং টাকাটা নে... আর পালা...’
পৃথার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কাজল। হটাৎ মনে হতে পৃথা হাঁক পাড়ে, ‘বেরিয়ে গেছিস নাকি?’
ও ঘর থেকে কাজলের গলা আসে, ‘না দিদিমনি, এই বেরুচ্চি, কিচু লাগবে?’
‘দেখ টেবিলের ওপরে বোধহয় আমার মোবাইলটা আছে, একটু দিয়ে যা না...’
মোবাইল নিয়ে ঘরে ঢুকে পৃথার দিকে বাড়িয়ে দেয় কাজল। ওর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে হেসে বলে ‘থ্যাঙ্কস্’।
‘আবার ওই সব... বলেচি না ও সব থ্যাঙ্কু ট্যাঙ্কু আমায় বলবে না...’ বলতে বলতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে...
‘ফ্ল্যাটের চাবিটা যাবার সময় নিয়ে যেতে ভুলিস না...’ গলা তুলে বলে ওঠে পৃথা
‘আচ্চা...’ কাজলের উত্তর আসে ড্রইংরুম থেকে, দরজা বন্ধ হয়ে যাবার শব্দ হয়।
মোবাইলটাকে পাশে রেখে একটু অপেক্ষা করে বিছানায় শুয়ে চুপ করে... তারপর মৃদু গলায় ডাক দেয়, ‘অর্নব... আছো?’
কোন উত্তর আসে না।
খানিক চুপ করে থাকে আরো পৃথা, তারপর ফের ডাকে, ‘অর্নব... আমি জানি তুমি আছো এই ঘরেই... একটু এসো না... ডাকছি তো...’
কোন উত্তর নেই।
আরো কয়’এক মুহুর্ত কেটে যায়... আর ডাকে না পৃথা, বিছানায় শুয়ে শুধু চুপ করে অপেক্ষা করে... তাকিয়ে থাকে বেডরুমের দরজার পানে। নিশব্দ ফ্ল্যাটের মধ্যে শুধু মাত্র ড্রইংরুমের বড় দেওয়াল ঘড়িটার টিকটিক আওয়াজটা ভেসে বেড়ায়।
হটাৎ বিছানার পায়ের কাছটার ফাঁকা জায়গাটা ভারী কিছুর চাপে দেবে, নেমে যায় খানিক... যেমন কারুর দেহের ভারে হয়ে থাকে। পৃথার মুখটা উজ্জল হয়ে ওঠে।
ক্রমশ...
0 Comments