মিতা টিভির থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমাকে তোমার খুব ভয় না? আমি যদি কিছু বলি, যদি তোমার দোষ ধরি, যদি ঝগড়া করি। কেন করি জানো, তোমার আমার সংসারটা সুখে রাখার জন্য। কি জানো গৌতম এই যে আমি ট্যুরে গেছিলাম কেরালা গোয়া গিয়ে তোমাকে ছেড়ে একটা ব্যাপার উপলব্ধি করেছিলাম সেটা হোল হয়তো তোমাকে ছেড়ে এসেছি এটাই ভাল। খারাপ লেগেছে ঠিকই কিন্তু কোথাও যেন একটা আলাদা আনন্দ ছিল, তোমার আমার গতানুগতিক ঝগড়া ছিল না, ছোটখাটো ব্যাপারে মতভেদ ছিল না। তোমার উপস্থিতি আমার কাছে, আমার উপস্থিতি তোমার কাছে মাথাব্যাথার কারন ছিল না। এটা ছিল তোমাকে ফোন করে তোমাকে কাছে পাওয়ার আনন্দ, তোমার গলা শোনার সুখ। এই বয়সে দূরে থাকাই কি সুখ যেটা তোমার আমার অস্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দ্যায়?’
না আমি এর উত্তরে কিছু বলতে পারি নি। মিতা না থাকায় সবসময়ে একটা অভাব অনুভব করেছি পাশে না থাকার অভাব। শুতে যাবার সময় শুন্যতার অভাব। ঝগড়া না করার অভাব, একে ওপরের থেকে দূরে সরে থাকার অভাব। আমরা কতো স্বার্থপর যে নিজেকে আবিষ্কার করি ওপরের চোখের দৃষ্টি দিয়ে, ওপরের উপলব্ধি দিয়ে। নিজের শুন্যতাকে পূর্ণ করি মেকি অভাব বোধ দিয়ে। এই কি জীবন? নিজেকে কেন দেখতে পারি না আমরা? এর উত্তর কে দেবে?
ট্যুরে যাবার দিন চলে এলো। আমি আবার মিতার থেকে দূরে যাবো। যা করবো সব লুকিয়ে থাকা অন্য জীবনের মতো। মিতাকে জানাব না যেমন মিতা আমায় জানাই নি। আমার কোন দুঃখ নেই ওর মুখ থেকে না জানতে পারার, আমি জেনেছি মিতার সুখ কিন্তু আমি কষ্টে নেই কারন আমার সুখ তো আমিও খুঁজে নিয়েছি মিতার অজান্তে। আমার অজান্তে মিতাও খুঁজে পেয়েছে ওর সুখ। তাহলে কেন এতো প্রশ্ন করবো নিজের মনকে।
যাবার আগের দিন মিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এবারে কোথাকার ট্যুর, ঠিক হোল কিছু?’
মিতা রান্না করতে করতে বলল, ’উহু, এখনো ঠিক হয় নি। তুমি ঘুরে এসো আগে তারপর দেখা যাবে।‘
মানে ও তৈরিই আছে আবার ট্যুরের জন্য। যাবার ইচ্ছে থাকলে যাক আবার। আমি তো আর নিয়ে যাই না। ও যদি পারে ঘুরতে তো ক্ষতি কি। অফিসে গিয়ে কাগজপত্র সব গুছিয়ে নিলাম। বসের সাথে দেখা করলাম। বস গুড লাক উইশ করলো। আমি নিজের চেম্বারে এসে বিদিশাকে ফোন করলাম। বিদিশা ফোন তুলতেই বললাম, ‘আমি কিন্তু তৈরি। তোমরা তৈরি তো?’
বিদিশা জবাব দিলো, ‘সেই জন্য আমি আর চিত্ত গুছচ্ছিলাম। মোটামুটি তৈরি।‘
আমি বললাম, ‘তোমার বন্ধু রিয়া?’
বিদিশা উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ, ও তৈরি। ওর আর কি। একজন মাত্র। আমাকে চিত্তরটা দেখতে হচ্ছে না।‘
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাটা কি বলছে? খুশি?’
বিদিশা বলল, ‘খুশি মানে। আমাকে এই কদিন আর ডিস্টার্ব করে নি। লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমিয়েছে। আর বারবার জিজ্ঞেস করছে কখন যাবো আমরা। কোথাও যায় নি না।‘
আমি ফোন রাখবার জন্য বললাম, ‘তাহলে কাল রাতে হাওড়া স্টেশনে দেখা হবে। ফুড প্লাজার ওখানে থাকবো। ঠিক সময়ে এসে পড়।‘
এরপর আমি নিকিতাকে ফোন করলাম। প্রথমত ওর সাথে অনেকদিন কথা হয় নি আর দ্বিতীয়ত ওর কাছে জানতে হবে এই রিয়া সেনটা কে। নিকিতা ওর ঘনিষ্ঠ ওর জানা উচিত। বেশ কিছুক্ষণ ফোন বেজে গেল কিন্তু নিকিতা ফোন তুলল না। খুব সম্ভবত ব্যস্ত। আমি আর রিং করলাম না। যদি ওর ইচ্ছে হয় তো করবে। কিন্তু মনের খুঁতখুঁতানিটা গেল না। অফিস থেকে বেরোবার একঘণ্টা আগে নিকিতার ফোন এলো।
নিকিতা বলল, ‘হ্যালো দোস্ত, সকালে ফোন করেছিলে। কিন্তু আজ একটু কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিলাম তাই ফোন তুলতে পারি নি। তারপর এবার তো অনেকদিন পরে ফোন করলে। কি হয়েছিলো না নিকিতাকে ভুলতে বসেছ। তুমি ভুললেও আমি ভুলতে দেবো না। তোমার জিভ…।‘ নিকিতা হা হা করে হেসে উঠলো।
আমি একটু আদুরে গলায় বললাম, ‘আরে তোমাকে কি ভোলা যায় নিকি। আমার জীবনে অনেক কিছুর যোগ ঘটিয়েছ তুমি। মিতা ছিল না অফিসে একটু চাপ ছিল তাই করে উঠতে পারি নি। তাছাড়া তোমাকে তো হড়বড় করে ফোন করা যায়না। তুমিও ব্যস্ত থাকো।‘
নিকিতা জিজ্ঞেস করলো, ‘মিতা বৌদি ছিল না, কোথায় গেছিল?’
আমি বললাম, ‘কোথায় আবার ট্যুরে? এবারে গোয়া গিয়েছিল।‘
নিকিতা- তাই নাকি? বাহ বৌদিতো খুব ঘুরছে। যে বন্ধুটা ঠিক করে দিয়েছিলাম তার সাথে?
আমি- কি করে বলব বল। আমাকে তো আর বলে নি। তাছাড়া তুমি বারন করেছো তাই আমিও জিজ্ঞেস করি নি।
নিকিতা- গুড বয়। তা ফোন কেন করেছিলে আমায়?
আমি- বিদিশাকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছি। অফিসের কাজে। বেশ কয়েকদিন লাগবে। তাই ভাবলাম যাই ওকে নিয়ে। ওরও মন ভালো হবে আর আমারও একটা সাথী হবে।
নিকিতা- ও তাই? খুব ভালো।
আমি- নিকি, বিদিশা একজনকে নিয়ে যাচ্ছে নাম রিয়া সেন। তুমি জানো ওকে? না বিদিশা আগে বলেছিল না তুমি বলেছ কোনদিন। হঠাৎ শুনলাম এই বন্ধুটার নাম।
নিকিতা- আগে বোলো ও যাচ্ছে বলে তোমার কোন অসুবিধে আছে কিনা।
আমি- অসুবিধে? এ আবার কি প্রশ্ন করলে তুমি? আমার অসুবিধে নেই, কিন্তু আমার সাথে চেনা জানা নেই তাই জিজ্ঞেস করছি।
নিকিতা- আমি জানি ওকে। বিদিশার খুব ঘনিষ্ঠ। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতো দিদির হাদসাটা হওয়ার পর। খুব ভালো মেয়েটা। অবশ্য এটা আমার বলা। তুমি কি জানবে ওর সম্বন্ধে সেটা তোমার ব্যাপার।
আমি- না আমার একটু আশ্চর্য লাগছে যে বিদিশা সব কথাই আমাকে বলেছে। এর কথা কোনদিন বলে নি। তাই ভাবছিলাম। তবে এবারে ও একটা কথা বলেছিল যে আমি আবার ট্যুরে ওকে নিয়ে গেলে ও একটা সারপ্রাইস দেবে আমাকে। এটাই বোধহয়।
নিকিতা- আরে তোমার এতো চিন্তা কেন? তুমি তো দুটো পাচ্ছ তোমার তো আনন্দ হওয়া উচিত। দুজনেরটায় মুখ দিতে পারবে।
নিকিতা আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। ওর এই হাসিটা আমার খুব ভালো লাগে।
আমি- সবার সাথে দেখা হোল। রিয়া অজানা কে মেয়ে তার সাথেও দেখা হবে। কিন্তু বন্ধু তোমার সাথে কবে দেখা হবে? তুমি কেন দেখা করছ না?
নিকিতা (আবার হাসল)- বুড়ো বন্ধু সবুরে মেওয়া ফলে। ওয়েট কর। ইন্তেজার কি ঘড়ি জলদহি সমাপ্ত হনেওয়ালি। হবে দেখা হবে। সেদিন তোমার খুব ভালো লাগবে দেখ।
আমি (দীর্ঘশ্বাস ফেলে)- জানি না সেদিন কবে আসবে। যাক ভালো থেকো।
নিকিতা- তুমিও ভালো থেকো আমার প্রিয় বন্ধু। তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।
খুব বেশি কিছু জানা গেল না নিকিতার থেকে। খুঁতখুঁতানিটা বারতেই থাকলো। তবে মাত্র তো আর কয়েকঘন্টা। তারপরে তো দেখবই। আর যদি ওকে নিয়ে কোন প্রব্লেম হতো তাহলে বিদিশা নিশ্চই ওকে আমার সাথে নিয়ে যেত না।
বাড়ি ফিরে এলাম। ব্যাগ সব গুছিয়ে রাখলাম। ব্যাগটা একটু ভারী হোল কারন জানি না কবে আসবো তাই কাপরজামার হিসেব করতে পারলাম না। অনেকগুলো নিতে হোল। ব্যাগটা হাতে তুলে দেখলাম। ভারী কিন্তু নিচে চাকা থাকায় অসুবিধে হবে না। মিতা ওর দিদির বাড়ি থেকে ফিরে দেখল আমাকে গুছোতে। জিজ্ঞেস করলো, ‘সব নিয়েছ তো?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ মোটামুটি সব নেওয়া। একটু বেশিই নেওয়া কারন জানতে পারছি না কবে ফিরব। দশ দিনের মতো নিয়ে নিয়েছি।‘
মিতা বলল, ‘ভালো করেছো। পরে কম পড়ার চাইতে বেশি থাকা ভালো। আমার দ্যাখো না এবারে আমার ব্রা আর প্যান্টি কম পরে গেছিল তাই বাইরে কিনতে হোল।‘
আগে মিতা কিনলে আমাকে দেখাত এখন দেখায় না। জানি না ওই প্রভকেটিভ জামাগুলো ও এখানে রেখেছে কিনা। অবশ্য না রাখলে রাখবে কোথায়। নিশ্চয় অনির্বাণকে দেবে না যে তুমি রেখে দাও পরে আবার নিয়ে আসবে।
তারপরের দিন আর অফিস যাই নি। ঘর থেকেই বেরিয়ে যাবো ঠিক করেছি। অফিসে সেটা বলেও দিয়েছি। আবার একবার কাগজপত্র দেখে নিলাম ঠিক আছে কিনা। বলা যায় না হুড়োহুড়িতে কোনটা নিয়েছি কোনটা নিই নি। হ্যাঁ সব ঠিক আছে। টাকাপয়সা সব দেখে নিলাম।
মিতা একবার মনে করিয়ে দিলো, ‘টাকা, ল্যাপটপ, মোবাইল সব সাবধানে রেখো। আবার হারিয়ে এসো না।‘
এই হচ্ছে মিতার আবার অন্য রুপ। কে জানে ভগবান একি অঙ্গে কতো রুপ দিয়েছে মেয়েদের। কখনো মা, কখনো মেয়ে, কখনো বা বন্ধু আবার কখনো অঙ্কশায়িনী। ধন্য ভগবান।
আমি জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ সব ঠিক করে নেওয়া। তুমি চিন্তা করো না।‘
মিতা বলল, ‘আমার আর চিন্তা কি। আমি তো জানি তোমাকে। একবার তো ট্যাক্সিতে মোবাইল রেখে চলে এলে। ল্যাপটপ অফিসে রেখে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরালে। এসব তো আমার সামনেই হয়েছে। তাই মনে করিয়ে দেওয়া। নাহলে তোমারি জিনিস তুমিই মনে রাখবে।‘
ঘটনাগুলো ঘটেছিল বটে। সুতরাং মিতা যদি মনে করিয়ে দ্যায় তাহলে ভুল কিছু করে না। আমি একটা ন্যালাক্ষেপা। মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায় বৈকি।
মিতা আবার বলল, ‘ফোন করতে একদম ভুলবে না। যখন ফ্রি থাকবে ফোনটা করো। আবার বোলো না কাজে এতো ব্যস্ত ছিলাম হয়ে ওঠে নি ফোন করা।‘
আমি এবার একটু বিরক্ত হলাম। যদি কেউ ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দ্যায় তাহলে রাগ হয় ঠিক, সেটা নিজের উপর। কিন্তু নিজের উপর তো আর রাগ দেখাতে পারি না তাই রাগটা গিয়ে পরে যে বলছে তার উপর। আমি বললাম, ‘হ্যাঁরে বাবা হ্যাঁ। যেন আমি করি না তোমায় ফোন। বারবার বোলো কেন বলতো?’
মিতা বলল, ‘এই তোমার প্রব্লেম। নিজের দোষ কিছুতেই স্বীকার করতে চাও না। আরে আমি তো তোমার স্ত্রী। তোমার ভালোর জন্যই বলা। খারাপ লাগলে আমার কিছু করার নেই। সাতপাকে বেঁধে এনেছ আমায়, পাক যতদিন না খুলবে ততদিন যত্নটা তো করতেই হবে। তোমার বোলো আমার বোলো।‘
আমি বললাম, ‘মরলেই সব সম্পর্ক শেষ তাই না মিতা?’
মিতা ভাবুক হয়ে বলল, ‘তাই তো বটে। তারপরে ছবি হয়ে দেওয়ালের একটা কোনে টাঙানো থাকবো বা থাকবে। বছরে একটা মালা আর সকাল সন্ধ্যে একটু করে ধুপের ধোঁয়া। এছাড়া আর কি।‘
সত্যি বটে মরার পর জানাও যায় না যাকে ছেড়ে এলাম তার কতোটা ভালোবাসা থেকে গেল, কতোটা দুঃখ হোল। সব অজানা থেকে যায়।
আমি বললাম, ‘সত্যি, শুধু দুদিন তারপর ঘুরিছে সংসার চক্র। কে কার জন্য ছিল কেউ জানবে না।‘
মিতা বলল, ‘তুমি ঘুরে এসো। দুজনে মিলে একটা কিছু আবিষ্কার করতে হবে আমাদের যে কেউ আগে চলে গেলে কি করা উচিত যাতে আমরা যে চলে গেল তাকে ভুলে না যাই।‘
আমি মিতার মুখে হাত দিয়ে ওকে থামিয়ে বললাম, ‘আজ এই কথাগুলো কেন মিতা? আমরা এখনো অনেকদিন বাঁচবো। এই পৃথিবী থেকে অনেক কিছু পাওয়ার আছে এখনো। তোমার আমার। দুজনের সম্পর্ক পুরনো হোলেও অনেক নতুন কিছু লুকিয়ে আছে যেগুলো একা একা খুজতে হয়। তুমিও খোঁজো আমিও খুঁজি। তাহলে হয়তো বেঁচে থাকার ইচ্ছে জিইয়ে রাখা যাবে।‘
মিতা বলল, ‘নাও তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি যাওয়া ভাল। টেনশন থাকবে না।‘
আমি ব্যাগ তুলে মিতাকে বললাম, ‘হ্যাঁ ঠিক বলেছ। যাই বেরিয়ে পড়ি। তুমি ভালো থেকো। মাঝে মাঝে দিদিকে নিয়ে এসে রেখো। মন খারাপ হলে ফোন করো।‘
মিতা বলল, ‘আমার কথা ভেব না। আমার এখানে সবাই আছে। নিজেকে দেখে রেখো। আর হ্যাঁ মদ বেশি না। শুধু দু পেগ কেমন?’
আমি মাথা নাড়ালাম। মিতার মাথায় হাত দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অফিসের কাজে আর মিতার সাথে আরও একবার বিশ্বাসঘাত করতে।
(চলবে)
0 Comments